বিজয়ের আনন্দে বেদনাও মিশে একাকার

জসিম উদ্দিন খান | বৃহস্পতিবার , ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আমাদের ভুল ভেঙেছে। আমাদের সন্তানেরাই আমাদের ভুল ভেঙে দিয়েছে। আমরা অভিভাবকেরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের সন্তানেরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, দিনদিন প্রযুক্তির অতি ব্যবহার ও তাতে নিমজ্জিত হয়ে থাকায় তাদের দ্বারা বোধহয় আর কোনো ভালো কাজ হবে না, আর কোনো সুন্দরের আশা করা যাবে না। তাদের সম্পর্কে আমাদের মনে যে বিরূপ চিন্তা ভাবনা ক্রমশ পুঞ্জীভুত হয়ে উঠছিল, তা যে কেবলই আশঙ্কা ছিল, হতাশার অলীক ভীতি ছিল মাত্রতাই প্রমাণ করে দিয়েছে, গত জুলাই আগস্ট ২০২৪ সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগান্তকারী সফলতার মধ্য দিয়ে। তাদের সামপ্রতিক ন্যায্য অধিকারের দাবিতে সংগঠিত হওয়া এবং লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং তাতে বন্দুকের নলের সম্মুখে বুক চিতিয়ে জীবন দিয়ে শেষ পর্যায়ে যে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করে তা ক্ষমতাসীন সরকারকে শুধু পদত্যাগ করতে বাধ্য করেনি, সরকার প্রধানসহ দলের অনেক নেতাকর্মীকে দেশ ছাড়তে পর্যন্তও হয়েছে। তাদের আন্দোলনে এমনই অগ্নিস্ফূরণ ঘটেছে যে, তা আমাদের সন্তানদের নিয়ে আমাদের দুর্বল মনে পুঞ্জীভূত ভাবনায় চপেটাঘাত করেছে এবং সন্তানদের এই তীব্র আন্দোলনে অভিভাবক তথা আপামর জনতাও শামিল হয়ে তাদের আন্দোলনের গতিধারাকে আরো বেগবান করেছে এবং চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই বিজয়কে তারা বাংলাদেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে অভিহিত করেছে।

দীর্ঘ একমাসব্যাপী শ্বাসরূদ্ধকর কঠিন আন্দোলন কোটা বাতিলের একদফা দাবি থেকে পরবর্তীতে আটনয় দফা এবং সর্বশেষে সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে রূপ নিয়ে সরকার পতনের পর দেশব্যাপী যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে গেছে তাকে কেবল স্বাধীনতার আনন্দের সাথেই তুলনা চলে। তাতে সারা দেশে ছাত্র জনতা ও এমনকি গৃহবধূ মা বোনরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে পড়েছে বিজয়আনন্দের আতিশয্যে। অবশ্য এই আন্দোলনে শত শত যেসব শিক্ষার্থী ও নিরীহ জনগণ নিহত এবং হাজার হাজার আহত কিংবা চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন তাদের পরিবার পরিজনদের বুকের হাহাকার ও বেদনাও মিশে একাকার হয়ে গেছে বিজয়ের এই আনন্দে।

শুধুই কি তাই? আমাদের সন্তানেরা এই দ্বিতীয় স্বাধীনতার আনন্দ প্রকাশ করেছে নানাভাবে নানা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। শহরের অলিতে গলিতে দেয়ালে দেয়ালে মনের মাধুরী মিশিয়ে গ্রাফিতি এঁকে সাজিয়ে দিয়েছে পুরো নগরকে। মনের আনন্দ, না বলা কথা, স্বপ্নের কথা রঙের তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছে ইচ্ছেমতো।

অন্যদিকে পুলিশ জনগণের বন্ধু হলেও ক্ষমতাসীন সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে নিরীহ ছাত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলি করে শতশত প্রাণকে নিঃশেষ করায় পুলিশ আর বন্ধু হয়ে থাকতে পারলো না এবং এই সুযোগে সবসময়ের মতো অপকর্মের সুযোগসন্ধানী চক্রের একটি অংশ পুলিশের উপর আক্রমণ করে পুলিশ হত্যা করায় পুলিশ আর জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রইলো না। সহকর্মী হত্যা ও নিরাপত্তার অভাবে পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনি মাঠ ছেড়ে চলে গেল আর শুরু হলো অপ্রত্যাশিত অরাজকতা, ভাংচুর, লুটপাট। আর এসবে ইন্ধন জুগিয়েছে সেই অপকর্মের সুযোগ সন্ধানী চক্র। যে শিক্ষার্থী জনতা দ্বিতীয় বিজয় ছিনিয়ে এনেছে তারাই আবার সদলবলে পাহারা দিয়েছে সকল স্পর্শকাতর ধর্মীয় স্থাপনা, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, দোকানপাট।

ট্রাফিক পুলিশ রাস্তা ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমাদের সন্তানেরাই রোদে দাঁড়িয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে ট্রাফিক পুলিশের কাজ করেছে। যদিও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় এবং অনভ্যস্ততায় তাদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শতভাগ সফল হয়নি, তবুও তাদের এ স্বপ্রণোদিত সাহসকে স্যালুট জানাই।

এর পরপর বন্যায় ঘরহারা, আশ্রয়হারা মানুষদের সহায়তা ও নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে তাদের পাশে থাকার যে দৃষ্টান্ত আমাদের সন্তানেরা দেখিয়েছে তা আমাদের কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। তাদের এমন মানবিক ভাবনা ও কর্মযজ্ঞ দেখে আমাদের বুক গর্বে ফুলে উঠে। কিন্তু ঐ যে বললাম, একটি চক্র আমাদের দুর্বার এবং তেজস্বী সন্তানদের এমনতরো সফলতা যাদের পছন্দ হয়নি বা হচ্ছে না, তারা শিক্ষার্থীর আদলে মুখোশ পরে এই বিজয়ের মহিমায় কালিমা লেপনে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল।

নিয়মবহির্ভূতভাবে কোথাও কোথাও মহান শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগের নামে অবমাননা করেছে, চাঁদা তুলেছে কিংবা ভাঙচুর করেছে স্পর্শকাতর স্থাপনায়। আর এসবের দায় শিক্ষার্থীদের কাঁধে চাপিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সেই অপচক্র।

ছাত্র জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকারপতন পরবর্তি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রধানতম কাজ হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়মিত গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে তার কাছে দেশ শাসনের ভার হস্তান্তর করা। কিন্তু শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে সরকার গঠিত হলে কোনো না কোনো দলই সরকারে আসবে। তখন দেশ জনতার ভাগ্যে যে লাউ সেই কদুই জুটবেএমনটাই মনে করছে আম জনতা।

মূলত পুরো গাড়ির কল কব্জা মেরামত করেই চালক নির্ধারণের পক্ষেই কথা বলছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। আর রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ অতি প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো আগে করেই দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুলছেন। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন হোক আর অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার করেই নির্বাচন হোকআমরা অভিভাবকদের একটিই প্রত্যাশা সবার আগে আমাদের সন্তানদের শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে নেয়া এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার অবারিত সুযোগ করে দেয়া। এ জন্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োজনীয় সংস্কারের দিকে সর্বাগ্রে নজর দিতে হবে। আমাদের কারো কারো সন্তানের তেজোদীপ্ত ন্যায্য আন্দোলনের এবং জীবনদানের বদৌলতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতের যেমন সুযোগ পেয়েছি এবং তার জন্যে গর্ব বোধ করছি, তেমনি কারো কারো সন্তানের শিক্ষা বহির্র্ভূত অন্যায্য ও শান্তিবিনাশী কর্মকাণ্ডের জন্য সংগঠিত হওয়া নিষিদ্ধের ঘোষণায় লজ্জিতও হচ্ছি। আমরা সবাই সব সন্তানের অভিভাবক। আমাদের সন্তানদের কেউ যেন কোনো দলীয় লেজুড়বৃত্তির অপকাজে ব্যবহার করতে না পারে, দলীয় রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে যেন কেউ আটকাতে না পারে, সেই সংস্কারটাই সর্বাগ্রে করা হোক এটাই প্রত্যাশা। সাথে সাথে শিক্ষকগণও যাতে পড়াশোনা, পাঠদান আর গবেষণা কর্মে নিবেদিত থেকে, দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত না থেকে দেশের সামগ্রিক রাজনীতির উপর নজর রেখে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও মতামত দিয়ে শিক্ষার্থীসহ পুরো জাতিকে আলোকিত করবেন সে প্রত্যাশাও করছি।

লেখক: কবি, গীতিকার, ব্যাংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজীবনানন্দ : শুধু কবিতার জন্যই মহাত্মা হয়ে আছেন যিনি
পরবর্তী নিবন্ধনগর সরকার ধারণা ও সংস্কার প্রসঙ্গে