পানি চুরি ও অপচয় ঠেকানো, গ্রাহক সেবা বৃদ্ধি এবং নগরীর প্রতিটি বাড়িতে পানি পৌঁছানোর লক্ষ্যে চট্টগ্রাম ওয়াসা ৯৬ হাজার ডিজিটাল মিটার স্থাপনসহ সাড়ে ৩ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পের সমুদয় অর্থের যোগান দেবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পটি প্রি–একনেকের অনুমোদন পেয়েছে। আগামী মাস নাগাদ একনেকের অনুমোদনের পর প্রকল্পটির মাঠ পর্যায়ের বাস্তবায়ন শুরু হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে ওয়াসার সিস্টেম লস ৩০–৩৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, বন্দরনগরীর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের পানির সংস্থানের একমাত্র উৎস চট্টগ্রাম ওয়াসা। নগরীর সম্প্রসারিত অংশের বেশ কিছু এলাকা এবং বাসাবাড়িতে ওয়াসার সংযোগ নেই। এরা ওয়াসাসহ বিভিন্ন উৎস থেকে নিজেদের পানির সংস্থান করলেও নগরীর বিস্তৃত এলাকার মানুষের পানির একমাত্র উৎস চট্টগ্রাম ওয়াসা। বর্তমানে ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্পে পানির উৎপাদন সক্ষমতা আছে দৈনিক প্রায় ৫৫ কোটি লিটার। ওয়াসা পুরোপুরি উৎপাদন না করলেও প্রয়োজনীয় পানির সংস্থান এসব প্রকল্পের মাধ্যমে করে থাকে। নগরীতে ওয়াসার ৮৬ হাজার ৩০৯ গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে আবাসিক গ্রাহক ৭৮ হাজার ৫৪২ ও বাণিজ্যিক গ্রাহক রয়েছে ৭ হাজার ৭৬৭টি। আবাসিক সংযোগের গ্রাহকেরা এক হাজার লিটার পানির জন্য ওয়াসাকে বিল পরিশোধ করেন ১৮ টাকা, অপরদিকে বাণিজ্যিক বা অনাবাসিক গ্রাহকেরা একই পরিমাণ পানির জন্য ওয়াসাকে বিল পরিশোধ করেন ৩৭ টাকা। ওয়াসা গ্রাহকদের কাছে প্রতি মাসে গড়ে অন্তত ২০ কোটি টাকা বিল প্রদান করে। ওয়াসার চারজন নারীসহ ৩৮ জন মিটার রিডার বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিটার দেখে বিল তৈরি করে থাকেন। স্বাভাবিকভাবে ৮৬ হাজার ৩০৯ গ্রাহকের মিটার রিডিং নিয়ে বিল করতে একজন মিটার রিডারকে ২ হাজার ২৭১ জন গ্রাহকের মিটার দেখতে হয়। যা বাস্তবে একটি অসম্ভব ব্যাপার। এজন্য মিটার রিডারেরা মিটারের কাছে না গিয়ে আন্দাজে বিল করে থাকেন। যাতে করে কোথাও বেশি পানি ব্যবহার করেও কম বিল পরিশোধ করেন, আবার কোথাও কম পানি ব্যবহার করে বেশি বিল দিতে হচ্ছে। মিটার রিডারেরা গ্রাহকের সাথে আপোষ করেও বিল বেশ–কম করেন। পানি ব্যবহার করেও বিল পরিশোধ করেন না অনেকেই। এতে করে ওয়াসার পানি চুরি এবং অপচয় একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এজন্য ওয়াসাকে প্রতিমাসে সিস্টেম লস দেখাতে হয় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি মাসে অন্তত ৭ কোটি টাকার পানি ওয়াসার সিস্টেম লসের কবলে পড়ছে।
ওয়াসার এই দুর্গতি লাঘব করতে বেশ বড় ধরনের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ৮৬ হাজার ৩০৯ গ্রাহকের বর্তমানের ম্যানুয়েল মিটার পরিবর্তন করে ডিজিটাল মিটার স্থাপন করা হবে। শহরের সম্প্রসারিত অংশে যেখানে ওয়াসার সংযোগ নেই সেখানে সংযোগ দেয়া হবে। যেসব এলাকার পাইপ নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো পাল্টে দেয়া হবে। ৫৫টি ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করে যেসব এলাকায় ওয়াসার পানি যায় না, সেখানে পানির যোগান দেয়া হবে। ওয়াসার বিলিং সিস্টেম অটোমেশন করা হবে। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটি ঘটবে তা হচ্ছে গ্রাহকের বাড়ি বাড়ি মিটার চেক করে রিডিং নেয়ার সিস্টেমের পরিবর্তে অত্যাধুনিক একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। যে প্রযুক্তিতে একটি রিসিভার নিয়ে একজন কর্মকর্তা গাড়িতে চড়ে একটি এলাকা দিয়ে যাবেন। ওই এলাকার যত ডিজিটাল মিটার রয়েছে সবগুলোর রিডিং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই রিসিভার রিসিভ করবে। যা ওয়াসার বিলিং সেকশনে এনে ইনপুট দিয়ে প্রতি মিটারের বিপরীতে আলাদা বিল তৈরি হয়ে যাবে। এতে সিস্টেম লস বা পানি চুরি ঠেকানো সম্ভব হবে বলেও সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান।
৩ হাজার ৭শ কোটি টাকার এই প্রকল্পটিতে ইতোপূর্বে বাস্তবায়ন করা একটি প্রকল্পের বাকি থাকা কাজও সম্পন্ন করা হবে। সিস্টেম লস কমানোর জন্য ওয়াসা ইতোপূর্বে বেশ কিছু কাজ করেছিল। রাঙ্গুনিয়া পানি শোধনগার প্রকল্পের আওতায় পুরো নগরীকে বিভিন্ন ব্লকে ভাগ করে তৈরি করা হয় এক একটি ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়া বা ডিএমএ। এই সিস্টেমে একটি এলাকার ৬/৭শ গ্রাহককে নিয়ে একটি ডিএমএ তৈরি করা হয়। ওই এলাকায় যে পাইপ লাইন থেকে পানি যায় সেখানে একটি মিটার স্থাপন করা হয়। মাস শেষে ওই মিটারে ব্যবহৃত পানি এবং ডিএমএ’র আওতাধীন গ্রাহকদের ব্যবহৃত পানি হিসেব করে দেখা হয়। নগরীর হালিশহর, আগ্রাবাদ, ফিরিঙ্গীবাজার, লালখানবাজারসহ বিস্তৃত এলাকায় এই ডিএমএ চালু করা হয়েছে। এসব এলাকায় ওয়াসার সিস্টেম লস ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। শহরের মোট ১০৫টি ডিএমএ’র মধ্যে ৫৯টি সম্পন্ন করা হয়েছে। এর আওতায় ৪৬ হাজার গ্রাহক পানি ব্যবহার করেন। নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে ৪৬টি ডিএমএ এর আওতায় বাকি ৪০ হাজার গ্রাহককে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সিস্টেম লস ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, বিশ্বব্যাংক প্রয়োজনীয় অর্থ দেবে। আগামী বছরের মাঝামাঝির দিকেই প্রকল্পটির কাজ শুরু করা সম্ভব হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।