মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে তা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ বিজয় অর্জিত হয়েছে। এ বিজয়ের গৌরব গাথা লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয় কখনো ম্লান হতে পারে না। কখনো মুছে যেতে পারে না। এর সাথে বহু ত্যাগ তিতিক্ষা ও আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। যেখানে জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ সংগ্রাম। যা পরবর্তীতে স্বাধীনতার স্বপ্নে পরিণত হয়। এ স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য জাতি মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। তার আগে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হয়। ২৫ শে মার্চ কালরাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি গণগত্যার শিকার হয়। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। দুই লক্ষ মা–বোনকে সম্ভ্রম হারাতে হয়।
১৯৭১ এর ১৬ ই ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা গৌরবোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অনেক জাতির স্বাধীনতা দিবস আছে কিন্তু বিজয় দিবস নেই। আবার যে বিজয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে এদেশের সর্বস্তরের মানুষ অংশ গ্রহণ করেছিল। সত্যিকার অর্থে এ যুদ্ধ জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ ছিল। দেশের প্রায় সকল মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের অংশ হয়ে গিয়েছিল। তার অন্যতম কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যে চেতনার মধ্য দিয়ে জাতির দীর্ঘ দিনের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন।
মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাই ছিল বৈষম্যহীন সমাজ কায়েম করা অর্থাৎ শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা, ন্যায় বিচার কায়েম করা। মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা করা। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসম্প্রদায়িক চেতনার মানবিক দেশ গড়ে তোলা। সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে অগ্রাধিকার প্রদান করা। গ্রামীণ জনপদের মানুষদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা। সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা এবং বৈষম্যহীন একই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা। সবাইকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার আওতায় নিয়ে আসা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। দল মত নির্বিশেষে সবার মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা। মানব অধিকার সংরক্ষণ করা। সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শোষণহীন মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
স্বাধীনতার দীর্ঘ সাতাশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তানি শাসনের যাতাকল থেকে বেরিয়ে এলেও সাধারণ মানুষের স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। যেসব ভিত্তির উপর বাংলাদেশ গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল সেসব ভিত্তিও অনেক সময় নড়েবড়ে হয়ে গিয়েছে। যেসব কারণে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে যেসব লক্ষ্য থেকে বার বার দূরে সরে গিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান দেয়া আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এক নয়। আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি অনেক কিছু সংগঠিত হয়েছে। স্বাধীন একটি দেশে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন কোনো সময়ে বন্ধ হয়নি। বার বার হত্যা খুনের ঘটনা ঘটেছে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এমনকি মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো সংরক্ষিত হয়নি। গণতান্ত্রিক ধারা নিশ্চিত হয়নি। মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষের মনে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মাঝেও এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নেমেছে। এ আন্দোলন সব ধরনের বঞ্চনার বিরুদ্ধে। এতে ছাত্রদের অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। সব শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। কয়েক দিনের মধ্যে এ আন্দোলন ছাত্র জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়ে যায়। অনিবার্যভাবে শাসক গোষ্ঠীর চরম পরিনতি ঘটে। স্বৈরাচারের পতন হয়।
ছাত্র জনতার গণ অভুত্থানে স্বৈরাচার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে নতুন আশা আকাঙ্ক্ষা জাগে। বিশেষ করে ছাত্রদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বৈষম্যবিহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখে। যেহেতু সরকার পতনের ঘটনাটা অনেকটা হঠাৎ করে হয়েছে তাই কেউ কেউ এটাকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলেছে। ঘটনাটা অনেক বড়, অত্যন্ত কঠিন, একেবারে দুর্ভেদ্য, অসম্ভবও বলা যায়, কিন্তু বৈপ্লবিক নয়। বিপ্লবের সাথে গণঅভ্যুত্থানকে এক করে দেখা যায় না। একটি বিপ্লবী সরকার যা করতে পারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা করতে পারে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয় না। এ সরকারের সাথে জনসম্পৃক্ততাও তেমন থাকে না। এরকম সরকারের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। এ সরকারকে স্বল্প সময়ের মধ্যে দ্রুততার সাথে সিদ্ধান্ত সমূহ বাস্তবায়ন করতে হয়। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিলেও শেষ করতে পারে না। সংস্কার দীর্ঘ মেয়াদী হলেও এর সাথে জনআকাঙ্ক্ষা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ সংস্কার চায়, পরিবর্তন চায়। আগের অবস্থায় আর ফিরে যেতে চায় না। সর্বক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন যা সময় সাপেক্ষ। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্কার কার্যক্রম নেয়া অধিকতর বাঞ্চনীয়।
বর্তমানের বৈষম্যবিহীন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের সাথে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের স্বপ্নের কোনো অমিল নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথেও কোথাও কোনো পার্থক্য নেই। বিরোধ থাকার প্রশ্নেই ওঠে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি বলে মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। যে স্বপ্ন ১৯৭১ সালে মানুষ দেখেছিল। স্বপ্ন পূরণ না হলে কিংবা স্বপ্ন ভেঙে গেলে মানুষ আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখে, নতুনভাবে জেগে উঠে। আগের স্বপ্নকে ধারণ করে নতুন স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যায়। ২০২৪ সালের যে স্বপ্ন তা মুক্তিযুদ্ধেরই স্বপ্ন, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। স্বাধীনতা একবার অর্জিত হয়, বার বার অর্জিত হয় না। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা কখনো ম্লান হতে পারে না। বিজয়ের গৌরবও কখনো ম্লান হয় না। কেউ চাইলে পতাকা বদলে ফেলতে পারে না। জাতীয় সোপানগুলো নিশ্চিহ্ন করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত গৌরবগাথাকে ভূলুণ্ঠিত করতে পারে না। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত মানচিত্রকে কখনো বদলানো যায় না।
যে কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এরকম ঐক্য আগে কখনো হয়নি। আসলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতি এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এখন কেউ কেউ বলতে চায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে জাতিকে বিভক্ত করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তাদের অনুসারীরা এরকম কথা বলতে পারে। ১৯৭১ এ জাতি যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এজন্য মুক্তিযুদ্ধ জাতিকে বিভক্ত নয় ঐক্যবদ্ধ করেছে, অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে একসাথে এগিয়ে চলতে শিখিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে স্বাধীন বাংলাদেশ জাতির এ ঐক্যকে ধরে রাখতে পারেনি। শাসক গোষ্ঠীরা জাতিকে বিভক্তির পথে নিয়ে গিয়েছে। যে বিভক্তির ধারা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের অবতারণা করেছে। যে বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি, আরো বহুকাল চলবে। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। ফলে অর্জিত সোপানগুলো বার বার হোঁচট খেয়েছে। প্রতিষ্ঠিত আর মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছে। যা একটা স্বাধীন দেশের স্বাধীন জাতীর জন্য কখনো মঙ্গলজনক হতে পারে না।
যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা ইতিহাস বিকৃতির কথা বলেছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার কথা বলেছে। বাস্তবে একেবারে নির্মোহ সঠিক ইতিহাস জাতি কখনো পায়নি। যে কারণে তরুণ প্রজন্ম বার বার বিভ্রান্ত হয়েছে। কতজন মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তার সঠিক তালিকা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে কারা ছিলেন তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যার জন্য এদেশের জনগণ যুদ্ধ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে বিগত সময়ের সরকারগুলো কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা কারো অজানা নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারে কাছে থাকলেও কখনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যহত হয় না। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না। মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। একনায়তন্ত্রের জন্ম হয় না, স্বৈরাচারের ভীত রচিত হয় না। এদেশে তা বার বার হয়েছে। তার পুনরাবৃত্তি কেউ আর চায়না। এবারের বিজয়ের মাস একেবারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। জুলাই আগষ্টের ছাত্র–জনতার গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে যে আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছে তা এবারের বিজয়ের মাসে ভিন্ন মাত্রা পাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা এক মোহনায় এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। এটাই এবারের বিজয় দিবসের প্রত্যাশা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।