মুদ্রা পাচারকারী শক্তিশালী একটি চক্রই চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অফিস সহকারী ওসমান সিকদারকে খুন করেছেন। পাচারকারীদের ২৯ হাজার রিয়াল মেরে দেয়ায় তাকে বিমানবন্দর আবাসিক এলাকাস্থ বাসায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে গাড়ির পেছনের ঢালায় ভরে লাশ সী বিচ এলাকায় ফেলে দেয়া হয়। ওসমান সিকদার নিজেও ছিলেন পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের এভিয়েশনের আরো বেশ কিছু কর্মকর্তা কর্মচারী মুদ্রা পাচারের সাথে জড়িত। ওসমান সিকদার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত তিনজন আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে খুনের বর্ণনা, কারা জড়িত এবং পাচারকারী চক্রের আরো অনেকের নাম পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছেন।
ওসমান সিকদার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত তিনজন হচ্ছেন, বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল, নিরাপত্তাকর্মী বাদল মজুমদার ও তাদের সহযোগী মোহাম্মদ আরিফ। বৃহস্পতিবার রাতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। পতেঙ্গা থানা–পুলিশ গোপন সূত্র এবং আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের গ্রেপ্তার করে। পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান গতরাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, খুনের ঘটনায় বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশনের দুই কর্মচারীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে আসামি ইব্রাহীম খলিল অতিরিক্ত চিফ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরকার হাসান শাহরিয়ারের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে পুলিশ জানতে পারে, গত ২৯ নভেম্বর বিমানবন্দর দিয়ে সৌদি আরবের মুদ্রা ২৯ হাজার রিয়াল পাচার ও ভাগ–বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে উসমান সিকদারকে খুন করা হয়।
বিমানবন্দরসংলগ্ন সরকারি কোয়ার্টারের বাসায় থাকতেন উসমান সিকদার।
পাচারকারী চক্রের সদস্য ফটিকছড়ির মোহাম্মদ রাসেল নামে এক ব্যক্তি ওসমান সিকদারের সঙ্গে ২৯ হাজার রিয়াল পাচার করতে দেন। কথা ছিল ইমিগ্রেশন পার হওয়া একজন যাত্রীর হাতে মুদ্রাগুলো তুলে দেয়ার। কিন্তু ওসমান সিকদার মুদ্রাগুলো ওই যাত্রীকে না দিয়ে নিজে আত্মসাৎ করেন। তিনি চক্রের অন্য সদস্যদের একটি গোয়েন্দা সংস্থার নাম বলে জানান যে, মুদ্রাগুলো গোয়েন্দারা নিয়ে গেছে। কিন্তু পরে বিমানবন্দরের কর্মচারী এবং চক্রের সদস্য ইব্রাহীম খলিল জানতে পারেন গোয়েন্দা সংস্থা কোনো মুদ্রা নেয়নি, সেগুলো ওসমান সিকদার মেরে দিয়েছেন। ইব্রাহীম খলিল বিষয়টি চক্রের অন্যদের জানিয়ে দিলে গত বুধবার রাত তিনটার দিকে ইব্রাহীম খলিলসহ ৫ জন একটি গাড়ি নিয়ে সিভিল এভিয়েশন আবাসিক এলাকাস্থ ওসমান সিকদারের বাসায় যান। তারা তাকে মুদ্রাগুলো ফেরত দিতে বলেন। কিন্তু ওসমান মুদ্রা ফেরত না দিয়ে বাড়াবাড়ি করলে কারা কারা মুদ্রা পাচারে জড়িত সব ফাঁস করে দেবেন বলে হুমকি দেন। এক পর্যায়ে ৫ জনে মিলে বাসার ভিতরেই ওসমান সিকদারকে বেধড়ক পেটানো শুরু করেন। দফায় দফায় পেটানোর ফলে এক পর্যায়ে তিনি নিথর হয়ে যান। পরে ৫ জনে মিলে তাকে গাড়ির পেছনের ঢালায় ভরে বীচ এলাকায় নিয়ে লিংক রোডের পাশে ফেলে দিয়ে চলে যান। সেখান থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। লাশের মাথায় ও শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের ভাই এমরান সিকদার বাদী হয়ে পতেঙ্গা থানায় হত্যা মামলা করেন। এতে গ্রেপ্তার দুই আসামি ইব্রাহীম খলিল, বাদল মজুমদার ও ফটিকছড়ির মোহাম্মদ রাসেল নামের এক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, পূর্বের আর্থিক লেনদেনের জেরে খুন করা হয়েছে উসমান সিকদারকে।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দীতে ইব্রাহীম খলিল নিজে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে সিভিল এভিয়েশনের আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারীর নাম জানিয়েছেন। এরা সকলেই মুদ্রা পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। তাদের কাজ হচ্ছে বিমানবন্দরের সব ধরনের তল্লাশি পার হওয়া নির্দিষ্ট যাত্রীর হাতে মুদ্রা পৌঁছে দেয়া। এর বিনিময়ে তারা নির্দিষ্ট অংকের হিস্যা পেয়ে থাকেন। সিভিল এভিয়েশন আবাসিক এলাকার বাসার ভিতরেই মুদ্রা লেনদেন হয় বলেও ইব্রাহীম খলিল জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন।
মামলার বাদী ও নিহতের ভাই এমরান সিকদার সাংবাদিকদের বলেছেন, ফটিকছড়ির রাসেল তার ভাইকে হুমকি ও চাপ দেওয়ায় তার দাবি মোতাবেক কথা মতো ২৯ হাজার রিয়াল বাবদ ৯ লাখ টাকা দিয়ে দিয়েছেন। এরপরও তার ভাইকে খুন করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানতে পেরে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলেও সূত্র জানিয়েছে। ওই কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বলেও সূত্র জানায়।