এডভোকেট সাইফুল হত্যার বদলা আইনীভাবে নিতে হবে

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৯:২৭ পূর্বাহ্ণ

সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন আবেদন নাকচকে কেন্দ্র করে গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত পাড়ায় যে লঙ্কাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তা দেশবিদেশের মানুষকে রীতিমত হতবাক করেছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে চিন্ময় দাসকে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে গ্রেফতার করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। চট্টগ্রামে তার বিরুদ্ধে মামলা থাকার কারণে তাকে চট্টগ্রাম কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পরের দিন মঙ্গলবার চট্টগ্রাম কোর্টে জামিনের শুনানি হয়। রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলীরা তার জামিনের বিরোধিতা করে। কিন্তু এতে ক্ষেপে যায় তার পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবীরা। তারা আদালত অভ্যন্তরে হৈ চৈ শুরু করে দেয় এবং আদালত চিন্ময়কে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আদালত পাড়ায় এই হিন্দু নেতার অনুসারীরা তাকে বহনকারী গাড়ি আটকে দেন। একপর্যায়ে কিছু উগ্র সদস্য মাটিতে শুয়ে পড়েন এবং অনুসারীরা হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে থাকেন। প্রথমে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিলেও পরে দেশের সম্পদ রক্ষার্থে জোটের সদস্যদের উপর লাঠিচার্জ শুরু করেন। চিন্ময়ের অনুসারীরা আদালত পাড়ায় ৫০ এর অধিক গাড়ি ভাংচুর করেন এবং কোর্ট মসজিদের জানালা ভাংচুরসহ মসজিদের ইমামকে পিটিয়ে আহত করে। এক পর্যায়ে রাষ্ট্র পক্ষের এপিপি এডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে রঙ্গম সিনেমা হলের দিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই ঘটনা চট্টগ্রামসহ সারা দেশের মানুষকে চরমভাবে বিস্মিত ও হতবাক করেছে। এদেশের মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একজন তরুণ আইনজীবীকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না আপামর জনসাধারণ, ক্ষোভে ফুঁসছে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের ছাত্রজনতা। কয়েকদফা নামাজে জানাজা শেষে তার গ্রামের বাড়ি লোহাগাড়ার চুনতি ফারেঙ্গা গ্রামে তার মরদেহ চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। সাইফুল আর কোনদিন ফিরে আসবে না এই গ্রামের আঁকাবাঁকা মাঠের প্রান্তরে। নিষ্পাপ দু’বছরের শিশু আর কোনদিন বাবা বলে ডাকতে পারবে না। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আর কোনদিন দেখবে না তার প্রিয় স্বামীর মুখটি। বৃদ্ধ মাবাবা আর কোনদিন ফিরে পাবে না তার প্রিয় সন্তানকে। হাজার হাজার মানুষের ঢল যেন উপচে পড়েছে ফারেঙ্গা গ্রামে। এডভোকেট সাইফুলের মরদেহ দেখার জন্য সেদিন জমিয়াতুল ফালাহ ময়দানে ভিড় জমিয়েছিল লক্ষ জনতা। তার এই মৃত্যু কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না। চোখের পানিতে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে জমিয়তুল ফালাহ ময়দান। কোন এক নিশাচর পাখির করুণ আর্তনাদ বিষিয়ে তুলছে চট্টগ্রামের আকাশবাতাস। বিদীর্ণ হয়ে পড়ছে পাহাড়গুলো। অসম্ভব এক ভালবাসায় আবদ্ধ করে ফেলেছে এডভোকেট সাইফুল ইসলামের কফিন। কফিন ঘিরে যেন উত্তেজনার পারদ জমেছে চট্টগ্রামময়। এই শোক যেন সইবার নয়। এই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর প্রত্যয় ঘোষণা উপস্থিতজনদের। গত ২৫ অক্টোবর একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে হাজারি গলির এক মুসলিম ওষুধ ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে চিন্ময়ের অনুসারীরা। হাজার হাজার সনাতনী ধর্মের অনুসারীরা সেদিন হাজারি গলি এলাকায় তান্ডব চালিয়েছিল। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর এসিড নিক্ষেপ করার মতন দুঃসাহস দেখিয়েছে। এই সেই চিন্ময় দাসযে কিনা নিউমার্কেট চত্বরে গেরুয়া পতাকা উড়িয়েছিল। আর সেজন্যই তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা হয়েছে। আর সেই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে চিন্ময়কে। চিন্ময় দাস ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে হিন্দুমুসলিম দাঙ্গা বাধানোর এক জঘন্য অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে বলে জানা গেছে।

গ্রেফতার হওয়ার আগে সে ঘন ঘন ভারতে যাতায়াত করেছে মর্মে বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ। তার এই ঘন ঘন যাতায়াতকে সন্দেহের চোখে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থা। যদিও ইসকন চিন্ময়কে অনেক আগে বহিস্কার করেছে বলে তাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা জানিয়েছেন। কিন্তু এটা কোনদিন বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। কারণ এতদিন তো তারা এই বহিষ্কারের কথা বলেননি। যখন তাকে গ্রেফতার, গ্রেফতার পরবর্তী তার অনুসারীদের তান্ডব, নিরীহ এডভোকেট সাইফুলকে নৃশংসভাবে হত্যাসবকিছু মিলে যখন চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশ উত্তাল এবং ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবিতে বিভিন্ন মহল থেকে আওয়াজ তুলছে তখন কেন তার বহিস্কারের কথা বলছে ইসকনের নেতারা? এতেই তাদের দূরভিসন্ধিমূলক অপতৎপরতার একটি আভাস পাওয়া যায়। বিগত ১৬টি বছর সারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, তাদের জমি দখল, বিভিন্ন হয়রানি হলেও এ ব্যাপারে জোরালো কোন কর্মসূচী ইসকন কিংবা অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি। যেমন: বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নিপুন রায় চৌধুরীকে নির্মমভাবে পেটানো, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্য দিবালোকে নিমর্মভাবে কুপিয়ে হত্যাএসবের বিরুদ্ধে কোন জোরালো প্রতিবাদ দেখা যায়নি তাদের। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের ৩ মাসের মাথায় দেশের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করার মানসিকতা নিয়ে যেন উঠে পড়ে লেগেছে ইসকন নামের জঙ্গী সংগঠন ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো।

কয়েকমাস আগে উগ্র হিন্দুরা দু’জন মুসলিম শ্রমিককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এর প্রতিশোধ যেন কোন মুসলিম জনতা নিতে না পারে সেজন্য দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মন্দিরের সামনে পাহারা বসিয়েছিল। এই উদারতা যেন এক অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে বাংলার ইতিহাসে। অথচ সেই সরলতার সুযোগ নিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকনের সদস্যরা দেশব্যপাী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য যেন এই উত্তেজনার পারদে ঘি ঢেলে দিয়েছে। এই উগ্রবাদী হিন্দু নেতা ভারতবাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে একহাত নেওয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। মূলত ভারত সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ইসকনকে বেপরোয়া করে তুলেছে। তারা ভেবেছেএডভোকেট সাইফুলকে হত্যার পর হিন্দুমুসলিম দাঙ্গা বাধাতে পারবে কিন্তু তাদের সেই সুপরিকল্পনা(!) ভেস্তে গিয়েছে। আর এটাকে ইস্যু করে বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষূন্ন করার একটা প্রয়াস পাওয়া যেত। তাদের সেই পরিকল্পনা মাঠে মারা যাওয়ার পর তারা ভোল পাল্টিয়ে চিন্ময় দাসকে ইসকনের বহিস্কৃত নেতা বলে প্রচার করছে। ইসকনকে নিষিদ্ধ করার আবেদন জানিয়ে সুপ্রীম কোর্টের ১০ জন আইনজীবী লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে সরকারকে। এডভোকেট সাইফুল হত্যার বদলা আইনীভাবে নিতে হবে। চিন্ময় দাসের ফাঁসি কার্যকর ছাড়া মরহুমের আত্মা কোনদিন শান্তি পাবে না। এদেশ সব ধর্মের সহাবস্থানের একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এদেশে অশান্তিঅরাজকতা সৃষ্টির কোন অপচেষ্টা করতে দেওয়া যাবে না। যারাই করবে তাদের প্রতি রাষ্ট্র সঠিক সিদ্ধান্ত নিবে আশা করি।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয় আমার অহংকার
পরবর্তী নিবন্ধগৃহকর্মী নির্যাতন নয়, প্রয়োজন সুরক্ষা