নগরীর অভিজাত এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে তারা বসবাস করেন। চলনে বলনে দুর্দান্ত স্মার্ট। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের হাতে ছবি তুলে এডিট করে দেন ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার। দেখলে মনে হবে কোনো ধনী ঘরের শিক্ষিতা তরুণী। নগরীতে শিকার খুঁজে বেড়ানোই তাদের মূল কাজ। নানা কৌশলে ধর্নাঢ্য ব্যক্তিদের হানি ট্র্যাপে ফেলে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে আদায় করেন লাখ লাখ টাকা। এই গ্রুপের নাম ‘ভিআইপি সিক্রেট গ্রুপ’। টেলিগ্রাম গ্রুপ নামেও পরিচিত। এক ব্যবসায়ীকে ফাঁদে ফেলার ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়ার পর ডবলমুরিং থানা পুলিশ ভিআইপি সিক্রেট গ্রুপের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। শুধু ডবলমুরিং এলাকায় নয়, ভিআইপি সিক্রেট গ্রুপের তৎপরতা রয়েছে নগরীর অন্যান্য থানা এলাকায়ও।
পুলিশ জানিয়েছে, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইমুসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অপরিচিত মানুষের সাথে বন্ধুত্ব পাতে সিক্রেট গ্রুপের সদস্যরা। নানাভাবে নানাজনকে প্ররোচিত করে। দুয়েকদিন চ্যাট বা কথা বলার পর দেখা করার প্রস্তাব দেয়। দামি হোটেল রেস্তোরাঁয় দেখা সাক্ষাৎও করে। খাওয়া দাওয়ার বিল শিকারের কাঁধে তুলে দিয়ে এরা লাস্যময়ী হাস্যময়ী হয়ে বিদায় নেয়। আবারো চ্যাটে প্রলুব্ধ করে। নিরিবিলিতে দেখা করার প্রস্তাব পাওয়ার সাথে সাথে তারা লুপে নেয়। নিরাপদ স্থানে যাওয়ার কথা বলে তারা ‘শিকার’কে তাদের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর ঘনিষ্ট হয়ে গোপনে ছবি ও ভিডিও করে। পরে তাকে জিম্মি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এক একটি কেস থেকে বেশ বড় অংকের টাকা হাতায় তারা। তা দিয়ে কয়েকমাসের বাসাভাড়া ও খরচ মিটে যায়। পারিবারিক শান্তি এবং মানসম্মানের ভয়ে ‘শিকার’ কোথাও মুখ খোলা বা প্রতিকার চাওয়ার সাহস করে না। আর এই সুযোগটিই সিক্রেট গ্রুপের সদস্যদের বড় পুঁজি বলে পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশ জানায়, গত ৬ নভেম্বর একজন চা–পাতা ব্যবসায়ীর সাথে ভিআইপি সিক্রেট গ্রুপের সদস্য নাবিলা আক্তার হ্যাপির (২০) পরিচয় হয়। পরিচয়ের সুবাদে হ্যাপি ওই ব্যবসায়ীকে গত ৯ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ১০টা নাগাদ কৌশলে নিজের বাসায় নিয়ে যায়। হ্যাপির সাথে দেখা করতে যাওয়ার পর সেখানে অন্যান্য কয়েকজন নারী পুরুষ মিলে ওই ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে ১২ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে। দাবি মোতাবেক চাঁদা না দিলে জানে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়। আসামিরা ওই ব্যবসায়ীর সাথে থাকা একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ও নগদ ১৮ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় এবং ১২ লাখ টাকার বাকি টাকা পরদিন দুপুরের মধ্যে পৌঁছে দেয়ার শর্তে ছেড়ে দেয়। পরদিন দুপুরের মধ্যে টাকা না পেয়ে বিকেল থেকে তারা ওই ব্যবসায়ীকে ক্রমাগত ফোন করে হুমকি এবং চাঁদার বাকি টাকা দাবি করতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে ওই ব্যবসায়ী ডবলমুরিং থানা পুলিশকে ঘটনাটি জানান। পুলিশ গত ১১ নভেম্বর রাত ২টায় পাঠানটুলী এলাকার বাসা থেকে আসামিদের গ্রেপ্তার করে। পুলিশ তাদের কাছ থেকে ৭ হাজার টাকা এবং একটি ফোন উদ্ধার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে তানজিল আক্তার (২৭), নাবিলা আক্তার হ্যাপি (২০), শামীমা আকতার (৩৬), মোহাম্মদ সাদেক হোসেন বাপ্পি (২২)। ওখান থেকে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ডবলমুরিং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী রফিক আহম্মদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, এটি একটি প্রতারক গ্রুপ। তারা কৌশলে বিভিন্ন ব্যবসায়ী এবং ধনীদের সাথে পরিচয় করে। তারপর তাদেরকে টোপে ফেলে বাসায় এনে নানা ধরনের ছবি ও ভিডিও করার পর মোটা অংকের টাকা আদায় করে। ভিআইপি সিক্রেট গ্রুপের সদস্যদের এটি মূল পেশা বলেও তিনি জানান।
ভিআইপি সিক্রেট গ্রুপের হাতে মোটা অংকের টাকা হারানো এক ব্যবসায়ী দৈনিক আজাদীর কাছে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, এরা ভয়ংকর। কিভাবে যে এরা তাদের টার্গেট করা ব্যক্তিকে বাসা পর্যন্ত নিয়ে যায় তা অনুধাবন করা কঠিন। সাংঘাতিক সব টোপ ব্যবহার করে তারা। মোবাইলে এমনভাবে পরিচিত হয় যেনো অন্য কাউকে খুঁজতে গিয়ে আপনার নম্বরে কল করে ফেলেছে। আবার হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারেও ওরা ‘নক’ দেয়। দারুণ সব ছবি ব্যবহার করে। চ্যাটে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে। দামি দামি হোটেল রেস্তোরাঁয় খেতে যায়। প্রেমের ফাঁদ তৈরি করে। নিরাপদ স্থানের নামে বাসায় নেয়ার পর তারা কৌশলে ঘনিষ্ট ছবি তোলে, ভিডিও করে। সবই করা হয় গোপনে। এর পরই তাদের চেহারা পাল্টে যায়। তখন পরিবার পরিজন এবং সামাজিক মান সম্মানের কথা চিন্তা করে তাদের দাবি না মেনে উপায় থাকে না। একবার প্রতারিত হওয়ার পর তিনি খোঁজ খবর নিয়ে নগরীতে অনেকগুলো সিক্রেট গ্রুপ আছে বলে নিশ্চিত হয়েছেন। প্রতারিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এদেরকে সন্দেহ করার কোনো উপায় থাকে না বলেও ওই ব্যবসায়ী জানান।