প্রযুক্তির নিত্য উৎকর্ষতার কারণে পৃথিবী এখন গ্লোবাল ভিলেজ। বিজ্ঞানীদের নিত্যনতুন আবিষ্কারে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশ, বদলে যাচ্ছে চেনা জগত। প্রযুক্তির উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে দেশ, বদলে যাচ্ছে গতানুগতিকতা, বিবর্তন ঘটছে মানুষের জীবনধারায়। মানুষের জীবন সহজ, আরামদায়ক ও নিরাপদ করতে প্রযুক্তি অবদান রাখছে বড়মাত্রায়। জীবনের মুখ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে প্রযুক্তি। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত আধুনিক প্রযুক্তির খোঁজ করে চলেছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত দক্ষতার উন্নয়ন ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ চাকরিহারা হতে পারেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি গবেষণায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত বিআইডিএস–এর বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘প্রযুক্তি, সাপ্লাই চেইন এবং প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান’ শীর্ষক অধিবেশনে এ গবেষণাটি উপস্থাপন করা হয়। অধিবেশনটি পরিচালনা করেন ইকোনমিক রিসার্চ গ্রপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির। গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন বিআইডিএস–এর গবেষণা সহযোগী ফারহিন ইসলাম।
সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন, গবেষক ড. মনজুর হোসেন, ড. কাজী ইকবাল এবং জায়েদ বিন সত্তারও পৃথক গবেষণাপত্র তুলে ধরেন এবং বক্তব্য দেন। এ সময় অপর এক গবেষণায় বলা হয়, দেশের তৈরি পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। ২০১৪ সালে দেশের এ খাতের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৫৬ শতাংশ। ২০২৩ সালে সেটি নেমে এসেছে ৫৩ শতাংশে।
বিআইডিএস–এর গবেষণা সহযোগী ফারহিন ইসলাম জানান, প্রযুক্তির উন্নয়ন হলে শুধু তৈরি পোশাক খাতে ১০ লাখ মানুষের চাকরি হারানোর আশঙ্কা করা হয়েছে। গবেষণায় আরও কিছু ক্ষতিগ্রস্ত খাত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। যেমন: অধাতু, খাদ্যপণ্য, চামড়া ও চামড়াসামগ্রী, ফার্নিচার, ফার্মাসিউটিক্যালস, প্লাস্টিক ও রাবারশিল্প। সলো গ্রোথ মডেল ব্যবহার করে ফারহিন ইসলাম দেখান, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়লে বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে ১৮ লাখ কর্মীর কাজ চলে যেতে পারে। তবে শুধু তৈরি পোশাক খাতই নয়, কোন খাতে এবং কোন এলাকায় কত মানুষের কাজ চলে যেতে পারে, এরও সম্ভাব্য হিসাব দেওয়া হয় এই গবেষণাপত্রে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিছু কিছু প্রযুক্তির উৎকর্ষ মানুষের কল্পনাকেও ছাপিয়ে গেছে। প্রতি দশকেই মানুষের প্রাযুক্তিক উন্নয়ন বিস্ময় সৃষ্টি করছে। ডিজিটাল হয়ে উঠছে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মহাবিশ্বের প্রায় সবকিছু। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির ইতিহাসে যুক্ত হচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। এখন বিশ্বের উন্নয়নের ধারণা বদলে গেছে, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার যে দেশে যত বেশি সেই দেশ তত বেশি উন্নত। মহাকাশজুড়ে হাজার হাজার স্যাটেলাইট পৃথিবীর দৃশ্যপট বদলে দেওয়ার মহানায়ক। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, আইপড, ট্যাব, অ্যাপল, অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুকের মোবাইল অ্যাপ, রোবট, ড্রোন, মোবাইল ব্যাংকিং,অনলাইনে কেনাকাটা, রাইড, সর্বাধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, ফিসিং প্রযুক্তিসহ বহু অভিনব প্রযুক্তি বিপ্লব সৃষ্টি করে চলেছে। আইফোন হ্যান্ডসেট হাতের মুঠোয় পুরে দিয়েছে আস্ত একটি কম্পিউটারকে।
গবেষণায় দেখা যায়, ১০ বছরে তৈরি পোশাক খাতের বেশির ভাগ উপখাতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। এ খাতের আটটি উপখাতের মধ্যে ছয়টিতেই কমেছে নারীর অংশগ্রহণ। ১০ বছরে তৈরি পোশাকের উপখাতগুলোর মধ্যে শুধু হোম টেক্সটাইল ও ওভেন খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। বাকি ছয়টি খাত অর্থাৎ নিট লিনজারি, ডেনিম ট্রাউজার, সোয়েটার, টি–শার্ট, জ্যাকেট, ওভেন ট্রাউজার ও ওভেন শার্টে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে জ্যাকেটে। এই উপখাতে ২০১৪ সালে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ ছিল ৬৩ দশমিক ১৩ শতাংশ; ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ২২ শতাংশে।
ড. মঞ্জুর হোসেন বলেন, দেশে এ মুহূর্তে প্রযুক্তির কারণে বড় ধরনের ছাঁটাই হচ্ছে, তা নয়। এর প্রভাব আছে। চীনের একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, চীনে প্রযুক্তির কারণে ৩ শতাংশ ছাঁটাই হলেও ২ শতাংশ নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া সবখানেই থাকবে। ফলে দরকার হচ্ছে, নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা বা তাদের নতুন দক্ষতা শেখানো এবং প্রয়োজনবোধে নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নারীরা কোথায় কোথায় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে সমস্যার মুখে পড়ছেন, তা চিহ্নিত করে তাদের নতুন দক্ষতা শেখানো দরকার। তাহলে নারীদের এই ঝরে পড়ার হার রোধ করা সম্ভব।
তাঁরা বলেন, যতটা বেকারত্ব আমরা অনুমান করেছি, তা শ্রম প্রতিস্থাপনকারী প্রযুক্তির চেয়ে শ্রম–বর্ধনকারী প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক কম হবে এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমশক্তির উন্নয়ন জরুরি বলে মনে করেন তাঁরা।