মোতাহের হোসেন চৌধুরী’র ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধটি নতুন করে পড়ছিলাম। এটি একসময় নবম–দশম শ্রেণিতে পাঠ্য ছিলো। একটি চমৎকার ও গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, যেটি সবসময় প্রাসঙ্গিক। এ ধরনের লেখাগুলো আমাদের সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে এবং আমাদের মনোজগতে শুভবোধ ও চিন্তাকে জাগিয়ে তুলতে পারে। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর জন্ম ১৯০৩ সালে নোয়াখালী জেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে, আর মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে।
১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর চট্টগ্রাম কলেজে যোগদান করেন। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ কলেজে অধ্যাপনা করেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরী ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের’ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি এই আন্দোলনে কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদির প্রমুখের সহযোগী ছিলেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘সংস্কৃতি কথা’। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে সৈয়দ আবুল মকসুদের সম্পাদনায় মোতাহের হোসেন চৌধুরীর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত সব লেখা ‘রচনাবলি’ আকারে প্রকাশিত হয়।
বলছিলাম তাঁর প্রবন্ধ ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ নিয়ে। প্রবন্ধে তিনি বলতে চেয়েছেন –শুধু জীবনধারণ করাটাই বাঁচা নয়, বরং বেঁচে থাকার জন্য চাই সৌন্দর্য, রসপিপাসা ও অর্থময় ভাবজগৎ। জীবনধারণের জন্য ভাত–কাপড়ের জোগান পর্যাপ্ত নয়, চাই সৌন্দর্যবোধ। যদি সৌন্দর্য না থাকে তবে জীবদ্দশায় নরক ভোগ করতে হয়। তাঁর প্রবন্ধটি আমাদের মানবিক হওয়ার পথে উদ্বুদ্ধ করে, মনুষ্যত্বের গল্প শেখায়, আমাদের মন তৈরি করে। তিনি লিখেছেন, ‘চিন্তার স্বাধীনতা, বুদ্ধির স্বাধীনতা, আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা যেখানে নেই, সেখানে মুক্তি নেই। মানুষের অন্নবস্ত্রের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে এই মুক্তির দিকে লক্ষ রেখে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর মানুষটিকে তৃপ্ত রাখতে না পারলে আত্মার অমৃত উপলব্ধি করা যায় না বলেই ক্ষুৎপিপাসার তৃপ্তির প্রয়োজন। একটা বড় লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি রেখেই অন্নবস্ত্রের সমাধান করা ভালো, নইলে আমাদের বেশি দূর নিয়ে যাবে না।
তাই মুক্তির জন্য দুটি উপায় অবলম্বন করতে হবে। একটি অন্নবস্ত্রের চিন্তা থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা, আরেকটি শিক্ষাদীক্ষার দ্বারা মানুষকে মনুষ্যত্বের স্বাদ পাওয়ানোর সাধনা। এ উভয়বিধ চেষ্টার ফলেই মানবজীবনের উন্নয়ন সম্ভব। শুধু অন্নবস্ত্রের সমস্যাকে বড় করে তুললে সুফল পাওয়া যাবে না। আবার শুধু শিক্ষার ওপর নির্ভর করলে সুদীর্ঘ সময়ের দরকার। মনুষ্যত্বের স্বাদ না পেলে অন্নবস্ত্রের চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়েও মানুষ যেখানে আছে সেখানেই পড়ে থাকতে পারে; আবার শিক্ষাদীক্ষার মারফতে মনুষ্যত্বের স্বাদ পেলেও অন্নবস্ত্রের দুশ্চিন্তায় মনুষ্যত্বের সাধনা ব্যর্থ হওয়া অসম্ভব নয়।’ লিখেছেন, ‘লেফাফাদুরস্তি আর শিক্ষা এক কথা নয়। শিক্ষার আসল কাজ জ্ঞান পরিবেশন নয়, মূল্যবোধ সৃষ্টি; জ্ঞান পরিবেশন মূল্যবোধ সৃষ্টির উপায় হিসেবেই আসে। তাই যেখানে মূল্যবোধের মূল্য পাওয়া হয় না, সেখানে শিক্ষা নেই।’
আমাদের এই শিক্ষাকে ধারণ করতে হবে। এটিই আসল শিক্ষা। আমরা বিশ্বাস করি, মানুষ শুধু বাধাবিপত্তির সঙ্গে যুদ্ধ করে এগোয় না, সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগোয়। প্রতিবন্ধকতা জয়ের ক্ষমতাই একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে অন্যদের থেকে আলাদা মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। মার্কিন লেখক উইলিয়াম ফকনারের মতে, ‘সে নশ্বর, কেবল এই কারণেই নয় যে সব প্রাণিজগতের মধ্যে তার অফুরন্ত স্বর রয়েছে; বরং এ জন্যই যে তার আত্মা রয়েছে, হৃদয় রয়েছে। সে আত্মত্যাগে সক্ষম, সমবেদনায় ভরপুর, তার সহ্যক্ষমতা অনেক।’
মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘সংস্কৃতি–কথা’য় লিখেছেন, জীবসত্তার কাজ ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে ছোটাছুটি করা। পক্ষান্তরে, মানবসত্তা মানুষকে মুক্তির আনন্দ উপভোগ করতে শেখায়। এই আনন্দ উপভোগ করার জন্য মানুষকে সংস্কৃতিবান হওয়া প্রয়োজন। সংস্কৃতিবান হওয়ার উপায় বর্ণনা করেছেন লেখক তাঁর এ লেখাটিতে।
আমরা নানারকম স্বপ্ন দেখি। অন্য অনেকের মতো আমার স্বপ্নও মানুষকে নিয়ে। মানুষের অগ্রগতি, সৌন্দর্য–চেতনা, সততার চর্চা আমাকে মুগ্ধ করে। তারপর আসে দেশের কথা, ভাষার কথা, মানচিত্রের কথা, স্বাধীনতার কথা। আমার সমস্ত লেখালেখি জুড়ে পাওয়া যাবে এসবের নিখাদ অস্তিত্ব।
নিজেকে প্রকাশ করা নিজের ভাবনা–চিন্তাকে অপরের মনে সংযোজিত করার অমোঘ ইচ্ছে অনেকের মতো আমারও। কবিতা বলি, ছড়া বলি, প্রবন্ধ বা গল্প, যা’ই বলি না কেন– এসবের মাধ্যমেই নিজস্ব ভাবনা–চিন্তার প্রতিফলিত হয়। আমরা জানি, সংস্কৃতি–চর্চার মাধ্যমে চিত্ত জেগে ওঠে, দৃষ্টি প্রসারিত হয়। তাই আমি চাই, শব্দের বিন্যস্ততায়, জীবনবোধের গভীরতায়, উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক, ছন্দ ও শৈল্পিক নিপুণতায় আমি উদ্ভাসিত হয়ে উঠি, কবিতায়–ছড়ায়। প্রেমের, দুঃখের, বেদনার, বিপ্লবের, ধ্যানের পরিপূর্ণ প্রকাশ যেন আমি আমার লেখায় প্রকাশ করতে পারি, সেই স্বপ্ন আমার নিরন্তর।
সেই স্বপ্নের আয়োজনের ধারাবাহিকতায় অল্প কয়েকদিন আগে আমরা একটি আসরের ব্যবস্থা করেছিলাম। করেছিলাম ছড়া পাঠ ও আবৃত্তি শীর্ষক এক অনুষ্ঠান। এতে সাত লেখকের ছড়া আবৃত্তি করেছিলেন বাচিক শিল্পী দেবাশীষ রুদ্র, সুবর্ণা চৌধুরী, সৌভিক চৌধুরী, মোহিনী সংগীতা সিংহ, তহুরা পিংকি, লিপি তালুকদার এবং ঊর্মি বড়ুয়া। তাদের আবৃত্তিতে উঠে এসেছে ছড়ার সৌন্দর্য। বাংলা ছড়া যে আধুনিক রূপে–গন্ধে পূর্ণতা লাভ করেছে, তা কণ্ঠের জাদুতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নতুন করে। অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন শিশুসাহিত্যিক গবেষক আহমেদ জসিম ও প্রাবন্ধিক ছড়াশিল্পী কলামিস্ট এমরান চৌধুরী। ছড়া পাঠ করেন ছড়াসাহিত্যিক সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার, মর্জিনা আখতার, কেশব জিপসী, বাসুদেব খাস্তগীর, গোফরান উদ্দীন টিটু, শওকত আলী সুজন এবং ফারজানা রহমান শিমু। স্বাগত বক্তব্য রাখেন শৈলী সাহিত্য বুলেটিনের সম্পাদক আজিজ রাহমান, শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ তরুণ কান্তি বড়ুয়া। মানুষের মুখে মুখে যে ছড়া গাওয়া হতো, কালের পরিক্রমায় সেটি চলে এসেছে কলমের মুখে, উঠে এসেছে পোস্টারে, ছড়িয়ে পড়েছে দেয়ালে–দেয়ালে। ছড়া শুধু সমাজ সংসার নিয়ে বলে না, দেশ ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও বলে। আবৃত্তিশিল্পীদের পরিবেশনা আমাদের মুগ্ধ করেছে, আমাদের আনন্দ দিয়েছে। মোতাহের হোসেন চৌধুরী’র প্রবন্ধগুলোর মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাহিত্য–সমালোচকরা বলেছেন, তাঁর ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’র মুখ্য বিষয়–একজন মানুষ সকল মানুষকে বলছে, ‘মানুষ হও, জীবনে আনন্দ নিয়ে বাঁচো।’ আমরাও চাই আনন্দ দিতে, আর আনন্দ নিতে। আনন্দ নিয়ে বাঁচতে।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী,
ফেলো (নম্বর–৪২২), বাংলা একাডেমি।