আন্তর্জাতিক লিও দিবস ২০২৪ : ‘যত্নের ছায়া ছড়ায় মায়া’

ডাঃ এম. জাকিরুল ইসলাম | বৃহস্পতিবার , ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বে লিও ক্লাবের সূচনা ও অগ্রযাত্রা: আজ থেকে প্রায় ৬৭ বৎসর পূর্বে ১৯৫৭ সালে ৫ই ডিসেম্বর বিশ্বে লিও ক্লাব আত্মপ্রকাশ করে। আমেরিকার পেনসেলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের মাল্টিপল জেলা ১৪ এর অন্তর্গত সাব ডিস্ট্রিক্ট ১৪ কে এর অধীনে গঠিত হয় বিশ্বের সর্বপ্রথম লিও ক্লাব ‘এভিংটন হাইস্কুল লিও ক্লাব’ যার অভিভাবকত্বে ছিল গ্লেন সাইড লায়ন্স ক্লাব। লায়ন জিম গ্রেভার যিনি এভিংটন হাইস্কুলের বেসবলটিমের প্রশিক্ষক ছিলেন, তিনি ছিলেন গ্লেন সাইড লায়ন্স ক্লাবের সক্রিয়সদস্য। তিনি লায়ন উইলিয়াম আরনেস্ট এর সহায়তায় এভিংটন উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৫ জন ছাত্রদের নিয়ে বিশ্বের মাঝে প্রথম লিও ক্লাবের অগ্রযাত্রা শুরু করেন যেখানে ২৬ জন ছিলেন বেসবল টিমের সদস্য। গ্লেন সাইড লায়ন্স ক্লাব ৫ই ডিসেম্বর ১৯৫৭ সাল ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট এভিংটন হাইস্কুল লিও ক্লাবকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা প্রদান করেন। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত এই ক্লাবটিই ছিল পৃথিবীর একমাত্র লিও ক্লাব। এরপর ১৯৬৩ সালে পেনসেলভেনিয়ার টামাকো অঞ্চল হাইস্কুল ও নিউইয়র্কে নতুন লিও ক্লাব গঠিত হয়। ১৯৬৪ সালের মধ্যে পেনসেলভেনিয়ায় ২৭টি ও নিয়ইয়র্কে ১ টি লিওক্লাব গঠিত হয়। ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল বোর্ড সভায় লিওক্লাবকে অফিসিয়াল প্রজেক্ট হিসাবে ঘোষণা দেওয়ার পর বিশ্বের মাঝে লিও ক্লাব দ্রুত বাড়তে থাকে।

১৯৬৮ সালে নতুন গঠিত লিও ক্লাবগুলো সনদের জন্য আন্তর্জাতিক সদর দপ্তরে আবেদন পাঠাতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালে এভিংটন হাইস্কুল লিও ক্লাবকে চার্টার দেওয়ার মাধ্যমে নতুন লিও ক্লাবকে আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর থেকে সনদ দেওয়ার প্রথা চালু হয়। লিও জন হেবার্ট ছিলেন পৃথিবীর প্রথম লিও ক্লাব এভিংটন হাই স্কুল লিও ক্লাবের সভাপতি।

১৯৬৭ সালে ১৮ দেশে ২০০ টি ক্লাব, ১৯৬৮ সালে ৪৮ দেশে ৯১৮ টি ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে ২০০০, ১৯৮৪ সালে ৪০০০, ১৯৯৬ সালে ৫০০০ লিও ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে পৃথিবীর ১৪২ টি দেশে ৭৩২২টি ক্লাবের মাধ্যমে প্রায় ১৭২২১৯ জন লিও সদস্য সেবাকর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে নিজেদেরকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরী করে নিচ্ছে। লিও শব্দের অর্থ নেতৃত্ব, অভিজ্ঞতা ও সুযোগ। লিও শব্দের আভিধানিক অর্থ সিংহ শাবক হলেও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে এর পরিচয় ভিন্নররূপে। লিও মনোগ্রামে দেখা যায় দুইটি সিংহ দুই দিকে তাকিয়ে আছে। এর অর্থ হচ্ছে একটির মাধ্যমে লিওরা তাকিয়ে থাকবে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে যেখানে তারা প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে অন্যের দিকে। অন্যটির মাধ্যমে লিওরা স্বস্বপেশায় আত্মনিয়োগ করে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।

লিও ক্লাবের মূল উদ্দেশ্য: ১৯৫৭ সালে গঠিত এভিংটন হাইস্কুল লিও ক্লাবের অভিভাবক গ্লেন সাইড লায়ন্স ক্লাব চারটি মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করার দায়িত্ব দেন।

দায়িত্বগুলো হলো:

. স্কুলের প্রশাসন ও অনুষদের সহযোগিতায় ছাত্রদের নেতৃত্বদান, পাণ্ডিত্য অর্জন, পৃথক দায়িত্ব, সততা ও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা অর্জনে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য স্কুলের সেবা করা। ২. সমাজের অভাবগ্রস্তদের প্রতি সাড়া দিয়ে সমাজের সেবা করা। ৩. গণতন্ত্রের আদর্শ এবং সরকার ও নাগরিকদের উন্নয়নে দেশের জন্য সেবা করা। ৪. লিও সদস্যদের বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সমঝোতার বন্ধনে আবদ্ধ করা।

যুব সমাজ নিয়ে আমাদের ভাবনা: লিওরা সঠিক পরিকল্পনা, পদ্ধতিগত কর্ম সম্পাদন ও সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এদেশে দুস্থ মানুষের রক্ত সরবরাহ লিওদের রুটিন মাফিক কাজ। লায়ন্স ক্লাবের সাথে যৌথভাবে চক্ষু পরীক্ষা, আই ক্যাম্প ও সার্জিকেল আই ক্যাম্পের আয়োজন করে এবং মরণোত্তর চক্ষুদান করে লিওরা অন্ধত্ব নিবারণের বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা কল্পে বৃক্ষরোপণ, রোপিত চারা পরিচর্যা ও বৃক্ষ নিধন রোধ কল্পে লিওদের ভূমিকা আজ জাতীয়ভাবে প্রশংসিত। মাদকমুক্ত ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে লিওরা বদ্ধপরিকর। দুর্যোগকালীন সময়ে লিওরা দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং বন্যা কবলিতদের মাঝে লায়ন্স ক্লাবের ত্রাণ সামগ্রী যথাসময়ে পৌঁছে দেয়। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে লিওরা বয়স্ক শিক্ষা, নৈশ বিদ্যালয়ও পরিচালনা করে থাকে। দুস্থ রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, ঔষধ সরবরাহ, গৃহহীনদের বাসস্থান নির্মাণে সহায়তা ও মেধাবী গরিব ছাত্র ছাত্রীদের আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা লিও সদস্যদের নিয়মিত কাজ। বাংলাদেশের যুব সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে মনীষী লায়ন আবদুল জব্বার খাঁন লিওইজমের গোড়াপত্তন করেছিলেন। উনার সেই মহতী উদ্যোগ অনেকাংশে সফল হয়েছে। কারণ যুবসমাজের যে অংশ লিওইজমে জড়িত তারা নিজেদের পড়ালেখা / চাকরি / ব্যবসার পাশাপাশি মানব সেবামূলক কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখে আত্মতৃপ্তি পান। লিওদের কোনো সন্ত্রাসমূলক কাজ ও বিপথগামী হওয়ার সুযোগ ও সময় থাকে না অথচ এই সময়টাতে একজন যুবক বিপথগামী হতে পারেন। আজ পর্যন্ত কোনো লিও সদস্য সন্ত্রাসমূলক কোনো কাজে জড়িত থাকার রেকর্ড নেই। আমরা অভিভাবকরা যদি আমাদের পোষ্য ও সন্তানদের লিওইজমে দীক্ষিত করতে সচেষ্ট হই তবে সমাজ থেকে সন্ত্রাসমূলক কাজ অনেকাংশে কমে যাবে।

লায়ন্স জেলা ৩১৫বি৪ বাংলাদেশ: বর্তমান লায়ন্স সেবা বর্ষ (২০২৪২০২৫) লায়ন্স জেলা ৩১৫বি, বাংলাদেশ এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সম্মানিত জেলা গভর্নর ‘যত্নের ছায়া, ছড়ায় মায়া’ ‘শেয়ার এন্ড কেয়ার’এর প্রবক্তা লায়ন কহিনুর কামালএম.জে.এফ সদ্য প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন এমডি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী পি.এম.জে.এফ ১ম ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ অপু এম.জে.এফ।

২য় ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন মো. কামরুজ্জামান লিটনএম.জে.এফ। কেবিনেট সেক্রেটারী পদে চৌকষ ও তারুণ্যদীপ্ত উদীয়মান লায়ন নেতা বেলাল উদ্দিন চৌধুরী ও ট্রেজারার পদে অভিজ্ঞ লায়ন মো. ইমতিয়াজ ইসলাম পি.এম.জে.এফ নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

লিও জেলা ৩১৫বি: মাল্টিপল লিও জেলা ৩১৫এর মধ্যে অন্যতম সক্রিয় লিও জেলা ৩১৫বি, বাংলাদেশ। মাল্টিপল লিও জেলা ৩১৫ এর অধীনে ৭টি লিও জেলা। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন প্রাক্তন জেলা সভর্নর লায়ন মোঃ মনজুর আলম মনজুপি.এম.জে.এফ। প্রতিষ্ঠাকালীন সচিব ছিলেন বর্তমানে রিজিয়ন চেয়ারপার্সন হেড কোয়ার্টার (এডমিন) লায়ন ডা. মো. জাকিরুল ইসলাম। বর্তমানে লিও জেলা ৩১৫বি৪ এর অধীনে ৪৭ লিও ক্লাবের মাধ্যমে দুই হাজারের অধিক লিও সদস্য সেবা কর্মকাণ্ডে নিজেদের সর্বদা নিয়োজিত রেখেছেন। লিও জেলা সভাপতি লিও দীপ্ত দে, সদ্য প্রাক্তন সভাপতি লিও আতিক শাহরিয়ার সাদিফ, সহসভাপতি লিও মো. ইরফান উদ্দিন চৌধুরী রনি, সেক্রেটারী লিও সিফাতুল ইসলাম সামি, ট্রেজারার লিও সিরাজুল করিম হিরো। লিও জেলা ৩১৫বি৪ এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মাল্টিপল জেলা ৩১৫ বাংলাদেশ এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সভাপতি লিও আকিব দিপু, সদ্য প্রাক্তন সভাপতি লিও লামিয়া করিম, সহসভাপতি ১লিও আতিক শাহরিয়ার সাদিফ, সহসভাপতি ২ লিও বাধন আহমেদ সেক্রেটারী লিও ফাহিম আশরাফ খাঁন ট্রেজারার পদে লিও দীপ্ত দে।

আমাদের প্রত্যাশা: আসুন আমরা পরম সম্মানিত জেলা গভর্নর লায়ন কহিনুর কামালএম.জে.এফ যুগপোযোগী ডাক ‘যত্নের ছায়া, ছড়ায় মায়া’ ‘শেয়ার এন্ড কেয়ার’ সফল বাস্তবায়নের জন্য এক যোগে কাজ করি এবং সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য আত্মত্যাগ করে সুপ্রিয় লিও জেলা সভাপতি লিও দীপ্ত দে এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ লিওইজমের ৫১তম বর্ষে ‘যত্নের ছায়া, ছড়ায় মায়া’ স্লোগানের সার্থক বাস্তবায়নে সমাজকে পরিবর্তনের লক্ষ্যে লিওদেরকে সেবার মানসিকতায় পরিচালনা করি এবং আগামী দিনের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলি। আসুন, আমরা সমাজের ভাগ্যাহত, অবহেলিত, জনগণের উন্নয়নে কাজ করে ‘ওদের মুখে হাসি ফোটাই’।

লেখক: রিজিয়ন চেয়ারপার্সন হেডকোয়ার্টার (এডমিন) লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল চিকিৎসক ও সমাজকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিবেক উপলব্ধি জাগ্রত হোক
পরবর্তী নিবন্ধজীবন রক্ষার্থে মৃত্তিকার যত্ন নেওয়া অপরিহার্য