আমাদের যখন বালক–বেলা, তখন গ্রামের রাস্তাগুলো ছিল কাঁচা, শীতে ধুলি উড়ত, বর্ষায় হতো হাঁটু সমান কাদা। সেই পথে ধুলি–কাদা মাড়িয়ে মানুষ হাঁটতেন, কেবল হাঁটতেন। ঘোর বরষায় ঝুম বৃষ্টিতে লাঙল–জোয়াল কাঁদে নিয়ে কৃষক মাঠে যেতেন, সামনে থাকত হাড় ঝিরঝিরে দুটি গরু। অঘ্রাণের গোধুলি বেলায় ধানের ভার কাঁধে ঘরে ফিরতেন কামলারা, সারি সারি। বিকালে গৃহস্থরা আয়েশে হেঁটে হেঁটে হাটে যেতেন, সূর্য ডোবার আগেই ঝুড়ি ভরে বাজার করে ঘরে ফিরতেন।
হাঁটতেন বৌ–ঝিরাও, গ্রামের মেটো পথ ধরে, ধান ক্ষেতের আইল দিয়ে, অনেকটা বেতারে শোনা সেই গানের মতোই
‘এক ডাইক্কা ছাতি ধরি পিচ্ছা ফিরি ফিরি,
বরঅ পইরর পুক পারদ্দি যারগৈ নাইয়রী’।
তিন যুগের ব্যবধানে বদলে গেছে সেই গ্রাম। গ্রামে এখন আর মানুষ তেমন হাঁটেন না। সড়কগুলোর বেশিরভাগই এখন পাকা। সেই পাকা সড়কে দাপিয়ে বেড়ায় ত্রিহুইলার টেক্সি, ম্যাজিক, ব্যাটারি রিকশা। সেই গাড়িতে সময় বাঁচিয়ে পা দুলিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছেন গ্রামবাসী। আহ! সেই ছেলেবেলা, বাবা–চাচার হাত ধরে নিজ গ্রামের বাজারে যাওয়া, দূর গ্রামে স্বজনদের দেখতে যাওয়া, হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা, কোনো গাছ তলে বসে একটু ঝিরিয়ে নেয়া, পথের ধারের প্রাকৃতিক কূপ বা নলকূপ থেকে দুই হাতে আজলা করে পানি খেয়ে আবার হাঁটা…এই কালের শহুরে শিশুরা কি অমূল্য এসব অভিজ্ঞতার স্বাদ পায়? তারা কি চেনে কোনটা ছড়া, কোনটা দিঘি, কোনটা পুকুর!
গ্রামের বিদ্যালয়গুলো এখন পাকা হয়েছে। আমাদের আমলে ছিল কাঁচা, বেড়া আর টিনের ছাউনি দেওয়া। কিন্তু কাঁচা বিদ্যালয় ঘরের পড়াশোনা ছিল পাকা। ডিসেম্বরে হতো বার্ষিক পরীক্ষা। বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়াও ছিল অনেকটা উৎসবের মতো। ভোরে উঠে পড়াশোনা, সূর্য উঠলেই এক দৌড়ে তিন রাস্তার মাথায় গিয়ে একটু রোদ পোহানো। পথ ছিল শিশির ভেজা, শিশিরে পা ভিজে যেত, ভিজে যেত পরনের লুঙ্গিও। যেদিন পরীক্ষার ফল বের হতো, সেদিন দুরুদুরু বুকে বিদ্যালয়ে যাওয়া, ভালো ফলের পর বীরের বেশে বাড়িতে ফেরা! এই দিন কি আর ফিরে আসবে! কালজয়ী আবদুল গফুর হালীর গানের মতোই বলতে ইচ্ছে করে…
সোনাচান্দি টিয়া পইসার নই রে কাঙাল,
তোরা আঁরে ফিরাই দে রে আর চোডকাল।
শীতকাল এলেই গ্রাম জেগে উঠত। বিনোদন ক্লাব বা বিদ্যালয়ের মাঠে হতো বিচিত্রা অনুষ্ঠান। কখনো শহর থেকেও শিল্পীরা গান গাইতে যেতেন, স্থানীয় তরুণরা নাটক মঞ্চস্থ (বই ভাঙতেন) করতেন। সবচেয়ে অদ্ভুত লাগত, যখন দেখতাম ছেলেরা মেয়ের পার্ট করত। কখনো তারা শাড়ি পরে নাচতও।
ওদিকে, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সভা হতো। সভায় ছোটো মেলা বসে যেত, সেখানে থাকত হরেক রকম খাবার। এক টাকার চারটা রসগোল্লা, মুখে দিলেই গলে যেত। বড় থালে ভাজা চনাবুট, তার উপর লাল পোড়া মরিচ, অনেকগুলো আস্ত ডিম। আট আনার চনাবুট ভাজা, বাদাম ভাজা আর কটকটি খেয়ে রাজ্যজয়ের আনন্দ হতো।
মনে পড়ে স্কুলে দুই ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই চলে আসতেন আইসক্রিমওয়ালা। মাঠে বসে ঢাকনা দিয়ে বক্সে দুটো বাড়ি দিতেন। বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর মন তখন সেদিকে। আমাদের স্কুলের আহমদ কবির স্যার, শফিউল আলম স্যার আইসক্রিমওয়ালাকে বলতেন; জোহরের ছুটিতে আসতে। আহ! নারকেল দেওয়া আট আনার সেই আইসক্রিমের স্বাদ কি এখনকার ৩৫ টাকা দামের চকবারে আছে!
শহরে কত বড় বড় মাছ। ছোটবেলায় গ্রামের বাজারে ১০ টাকায় এক পোয়া বাটা বা টেংরা মাছ পাওয়া যেত। বেগুন দিয়ে রাঁধা সেই বাটা মাছের স্বাদ বড়বেলায় আর কোথাও তো পেলাম না। শীতের শুরুতে মুলা শাক, গরম কালে নারিচ শাক (পাট শাক), বর্ষায় কলমী শাক দিয়েই ভাত খাওয়া শেষ হয়ে যেত। গ্রামে আমরা গরুর মাংস খেতাম ঈদে চাঁদে, নানা পরবে। যেমন শবে বরাত, শবে কদর, মহররম, ফাতেহায়ে ইয়াজদাহমের মতো বিশেষ দিনগুলোতে বাজারে অনেকগুলো গরু জবাই করা হতো। আশির দশকের মাঝামাঝি গরুর মাংসের কেজি ছিল ৪০–৫০ টাকা। গ্রামবাসী উৎসব করে মাংস কিনতেন। বিকালে চালের রুটি দিয়ে পরিবারের সবাই মিলে সেই মাংস খাওয়া হতো। সেই পরবেও অনেক গরিব মানুষ মাংস কিনতে পারতেন না। তারা গরুর ভুড়িটা নিয়ে পরিষ্কার করে রান্না করতেন। এখন সেই ভুড়িও মাগনা মেলে না, বাজারে ভাল দামে বিক্রি হয়।
আহ! আমার আরেকটা প্রিয় কাজ ছিল মাছ ধরা। বাড়ির সামনে ছোটো একটা খাল ছিল। বিকালে ঝাকি জাল দিয়ে মাছ ধরতাম। চিংড়ি, কই, টাকি, পুঁটি মাছে ভরে যেত জাল। একবার প্রায় আমার সাইজের একটা বোয়াল মাছ পড়েছিল জালে। মাছটা জালসহ আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, আমার চিৎকারে বড় ভাই দৌড়ে এসে মাছ আর আমাকে খাল থেকে তুলেছিল। এখন সেই খালে পানিই নেই, মাছ তো দূরের কথা। ছেলেবেলায় আর কী করতাম আমরা…
কাগজ দি বানাইতাম নৌকা
বইর পাতা ছিরি,
ভাইয়ে ভাইয়ে নোয়া জামা
গইত্যাম কাড়াকাড়ি।
মাইজ্যার পছন হলুইদ্যা রঙ
আঁর পছন লাল।
তোরা আঁরে ফিরাই দে রে আঁর চোডকাল।
স্কুলবেলার বিকেলটা ছিল সোনায় মোড়ানো। স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেয়ে চুপি চুপি ঘর থেকে বের হয়ে মাঠে ছুটতাম। মাঠ বলতে ধান কাটার পর বিস্তীর্ণ বিলটাই ছিল আমাদের মাঠ। সেই মাঠে ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্ধা (গ্রামে বলে মঅল খেলা), হাডুডু খেলায় মেতে উঠতাম। খেলায় সাথীদের সঙ্গে মারপিট, বাড়িতে এসে বিচারের মুখোমুখি হওয়া আহ, সোনাঝরা বিকেল, আতঙ্কের রাত! মনে কি পড়ে?
শীতের শুরুতে আমাদের আরেকটা কাজ ছিল বিল থেকে খড় যোগাড় করা। এই খড় সারা শীতে আগুন পোহানোর কাজে ব্যবহার হতো। চট্টগ্রামে প্রবাদ আছে ‘মাঘের শীতে বাঘ গুজরে’। সেই শীতে ছেলে–বুড়ো সবাই গোল হয়ে আগুন পোহানোর স্বাদ এই নগরে কোথায় মিলবে? ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর সুখ আমি কোথায় পাব তারে!
গ্রামের আরেকটা ঐতিহ্য ছিল সিন্নি ও ফলার খাওয়া। গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে মানত করে সিন্নি রান্না হতো। পাড়ার বাচ্চাদের সেই সিন্নি খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেওয়া হতো। বিশেষ করে ‘কেলা সিন্নি’ খাওয়ার স্মৃতি আমার মনে এখনো তাজা। এটা ছিল গ্রামীণ লোকাচার। কলা গাছে প্রথম যে ছড়াটা ধরে সেটা দিয়ে ‘কেলা সিন্নি’ করা হতো। চালের গুড়োর সাথে কলা মিশিয়ে এই সিন্নি তৈরি করা হতো, আহ, সিন্নির কী স্বাদ!
খাওয়ার কথা যখন উঠলোই, পিঠাপুলির কথা বাদ যাবে কেন। এই স্মৃতি কারই বা নেই? রাতে ঢেঁকি চলছে, চাল থেকে গুড়ো তৈরি হচ্ছে, সকাল না হতেই পাকঘর (গ্রামে বলে বউজখানা, অঁওলা) থেকে ভেসে আসছে মৌ মৌ গন্ধ। মুখ ধোয়ার সময় কাথায়, বাসি মুখেই গরম গরম দুই চারটা ভাপা পিঠা খেয়ে নেয়া, তারপর পুকুর বা কলের দিকে ছোটা। তখন মুরব্বীরাও বাচ্চাদের এই অপরাধটুকু হাসিমুখে মেনে নিতেন। আহ, কোথায় গেল সেই দিনগুলি!
সংগীতজ্ঞ আবদুল গফুর হালীর আরেকটি গানের কথা মনে পড়ছে…
মনে হঅর আবার গুরা অইবল্লাই
মানুষর বস্সান কমাইত
এন কনঅ মেশিন নাই রে যন্ত্র নাই।
মনে হঅর আবার গুরা অইবল্লাই।
আচ্ছা আবার যদি ছোটো হতে পারতাম, আবার যদি ফিরে আসত সেই দিনগুলি, বাঁশি বাজানোর দিনগুলি, তাহলে কেমন হতো!
কিংবদন্তী আবদুল গফুর হালীর গানে আছে সেই উত্তর…
নানা–নানী দাদা দাদি
আবার ফিরি আইসত যদি
রাজা–বাদশার কিস্তা হইত
ডিয়ালাত পাটি বিছাই
মনে কঅর আবার গুরা অইবল্লাই।
লেখক : সাংবাদিক ও চট্টগ্রামের লোকসংগীত গবেষক।