লেডিস ক্লাব ঐতিহ্য ও আস্থায়

ডেইজী মউদুদ | শনিবার , ৩০ নভেম্বর, ২০২৪ at ৬:৪২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব। সংসারের চার দেয়ালে আবদ্ধ নারীদের জন্য মুক্ত এবং খোলা আকাশে মনের আনন্দে উড়ে বেড়ানোর এক অবারিত অঙ্গন। আজ থেকে দীর্ঘ ৬৪ বছর আগে চট্টগ্রামে যেসব মহীয়সী নারীরা নিজেদের জন্য আলাদা এই ক্ল্বাবটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমি তাদের সশ্রদ্ধ কুর্ণিশ জানাই। উনারা কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং উন্নত চিন্তার অধিকারী ছিলেন, তা ভেবে অবাক হই । পরম শ্রদ্ধায় তাদের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে ইচ্ছে করে। উনারা সেদিন নারীদের জন্য যে বীজবপন করেছিলেন তা চারাগাছ থেকে পত্রপল্লব আর শাখাপ্রশাখায় বিস্তৃত হয়ে আজ যেনো বিশাল এক বটবৃক্ষে পরিণত। সার্থক ও ধন্য প্রতিষ্ঠাকালীন পূজনীয় বরেণ্য নারীরা। কথা হলোউনারা তো প্রতিষ্ঠা করে গেলেনকালেকালে, যুগেযুগে এই ক্লাবকে যারা সচল ও চলমান রেখেছেন, তারাও ধন্যবাদ ও প্রশংসার দাবিদার। তা না হলে সেইকালের টিলার উপর নির্মিত ক্লাবটি আজ এই অবস্থানে কোনোদিনও আসতে পারতো না।

ক্লাব প্রেসিডেন্ট খালেদা আউয়াল বলেন, লেডিস ক্লাব ইতিমধ্যেই গৌরবের ৬৫ বছর অতিক্রম করেছে। ১৯৮৮ সাল থেকেই এই ক্লাবের সাথে আমার সম্পৃক্ততা। নগরীর কিছু সম্মানিত নারী ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁদের আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। তবে, ক্লাবের প্রেসিডেন্টের দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন জিনাত আজম। তাঁর পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টায় এই ক্লাবটি উত্তরোত্তর উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যায়। ক্লাবের বোনেরাই এই ক্লাবের মূল চালিকাশক্তি । তাঁদের আন্তরিকতা, নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিক সহযোগিতায় লেডিস ক্লাব আজ এই অবস্থানে এসে উপনীত হয়েছে,বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতায়। মেম্বাররা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বালিকা সদন পরিচালনা, মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান, অবহেলিত ও অসহায় মানুষের সাহায্য প্রদানসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই ক্লাব এখন আমাদের মেম্বারদের আস্থার আবাসে পরিণত হয়েছে। এখানে গৃহিণীরা যেমন আছেন, তেমনি রয়েছে পেশাজীবী নারীরাও। ফলে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে ক্লাব অঙ্গন মুখরিত থাকে সদা।

নবনির্বাচিত কমিটির সাহিত্য সম্পাদক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক কাজী রুনু বিলকিস বলেন, লেডিস ক্লাব সদস্যদের কাছে খোলা জানালার মতো। নিয়মিত ক্লাব মিটিংগুলোও অনেকটা আনন্দ আয়োজনের আমেজে হয়। মেম্বাররা ঘর সংসার সামলিয়ে বিনোদনের মেজাজ নিয়েই আসেন। পরস্পরের সুখ দুঃখ শেয়ার করেন। যৌথ পরিবার বিলুপ্ত হওয়ায় এখন সবাই একা । ফলে এই ক্লাব এখন মেম্বারদের জন্য পরম এক স্বস্তির জায়গা। এক খণ্ড উন্মক্ত আকাশের মতোই। সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মানবিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মেম্বাররা নিজেদের বিকশিত করছেন। নিজেরা আলোকিত হচ্ছেন, সমাজকেও আলোকিত করছেন।

কথা হয় ক্লাবের আরেক সদস্য হাফসা সালেহর সাথে। তিনি বলেন, লেডিস ক্লাব নারীদের জন্য অনন্য এক প্ল্যাটফরম। নারীদের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ক্লাবের প্রতিটি উদ্যোগ সমাজে ইতিবাচক অবদান রাখছে, ফলে বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিও সচেতন হন মেম্বাররা। ক্লাবের মেম্বাররা একে অপরের সাথে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আন্তরিক এক সম্পর্কের নিগড়ে বন্দী হন। নারীদের জন্য তো বটেই, সমাজের জন্য এই ক্লাবের মেম্বাররা এক শক্তিশালী মাধ্যম যেনো। দীর্ঘদিনের পথ পরিক্রমায় নারীরা প্রমাণ করেছেন, নারী সমাজ একই ছাদে বসে কাজ করে সমাজে অনেক পরিবর্তন আনতে পারে।

সেদিনের প্রবীণেরা নবীনদের নেতৃত্ব বিকশিত করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন . বলেই এই ক্লাব দীর্ঘ ছয় দশকেরও বেশি সময়ের পদচারণাকে নানা কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধ করেছে। যে নারীকুল ঘর সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ তাদেরকে এক ছাদে মিলিত হবার এক আনন্দময় জগৎ রচনা করে দিয়েছেন। সেদিন ছিল লেডিস ক্লাবের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। হেমন্তের ঝিরিঝিরি সন্ধ্যায় যখন অনুষ্ঠানে গিয়ে পৌঁছলাম, মনে হলো যেনো এক বিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করছি। সেদিনে টিনের চালা আজ বিশাল এক অট্টালিকা যেনো। বিজলি বাতির ঝিলিক আর সাজ সাজ রব। পুরো ক্লাব জুড়েই। আনন্দধারা। আর ক্লাব সদস্য অতিথিরা মিলে যেনো এক অপূর্ব নারীমেলা। নারীমেলা বললে কম হবে, সুন্দরীদের মিলনমেলা। নানা রকমের নানা বয়সের। অবশ্য এই আয়োজন কেবল সেদিন যে প্রথমবার হলো তা নয়।। প্রতিটি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী যেনো এক একটি দারুণ দারুণ উৎসব। আমার পরম সৌভাগ্য আমি এই ক্লাবের অগণিত অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি। ধরতে গেলে ৮০র দশক থেকেই আমি তাদেন বহুমুখী কর্মযজ্ঞের সাথে পরিচিত। প্রথমতঃ সাংবাদিকতার কারণে সব নিউজ আমি করতাম। আবার নানান প্রোগ্রাম উপভোগ করে একটি রিভিউ ছাপিয়ে দিতাম। আমি আজ স্মরণ করছি আমার শ্রদ্ধেয় ফাহমিদা আপাকে, সালমা চৌধুরী আপা, পরাণ খালাম্মা , রুনু সিদ্দিকী খালাম্মা , বেতারের লুসি আপা সহ আরো অনেক গুণী নারীদের । যাদের অপার স্নেহ আর ভালোবাসায় প্রতিনিয়ত আমি নিজেকে ঋদ্ধ করেছি। আর এই ক্লাবের প্রধান কাণ্ডারী খালেদা আউয়াল আপা আর জিনাত আপার কথা বলে শেষ করতে পারবো না। উনাদের গতিশীল নেতৃত্বে এই ক্লাব দিনে দিনে উন্নতির চরম শিখরে আজ উপনীত। ক্লাবটিকে তাঁরা কেবল বিনোদনের জায়গায় আটকে রাখেনি। কত কত সামাজিক কাজ করে যাচ্ছেন। নারী উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন, সুবিধাবঞ্চিত নারীদের সহযোগিতা করছেন। দেশের সংকট ও দুর্যোগে ছুটে যান দুর্গতদের পাশে। আরো কত কত কাজ। এসব করার জন্য ক্লাবের নিয়মিত সভা, মাসিক খাবারদাবারের আয়োজন, বিভিন্ন উৎসব ও জাতীয় দিবসগুলো পালন থেকে শুরু করে নানান কাজে নিজেদেরকে সদা নিয়োজিত রাখেন। আমি খালেদা আপা আর জিনাত আপাকে একেবারে নবীন বয়স থেকেই দেখে আসছি। কি সুন্দর আর পরিপাটি। যেমন গেটআপ, তেমন বক্তব্য আর কথামালায় সেরার সেরা। অনেকেই সেরা আছেন। এই দুজনকে বেশি দেখেছি, যেহেতু , উনারা নেত্রী ছিলেন, এখনো আছেন , তাই তাদের কথা ঘুরে ফিরে লেখাতে অজান্তেই এসে পড়ছে। সেদিনে নবীনেরা আজ প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ। নবীনদের পদচারণায় ক্লাব এখন মুখর। যে দিকে তাকাই কেবল সুন্দর আর সুন্দর। অনেক অচেনা মুখ। । মঞ্চ আলোকিত করে বসা অতিথিরা সবাই আমার প্রিয় মুখ। জয়নাব আপাকে আমি দেখছি আমার শিশুকাল থেকেই। সেই ছোটবেলায় তিনি আমার থুতনি ধরে আদর করে বলেছিলেন, কি মিষ্টি মেয়ে, সেই সংলাপ আমার এখনো মনে আছে। আর খালেদা আপার আপার ভালোবাসা,বক্তব্য,লিডারশিপ,সৌজন্যবোধ আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। আর জিনাত আপাতো আমার নানী। আমার আপন মেজো মামীর মেজোমামী। সেই ৮৬ সালে অফিস থেকে উনার বাসায় গিয়েছিলাম কোনো একটা বিষয়ে উনার কমেন্ট নেয়ার জন্য। তো আজম সাহেব ছিলেন। তিনি নারী সাংবাদিক দেখে বলেন, তোমরা এতোজনকে সংবর্ধনা দাও, উনি তো সাংবাদিক, উনাকে দিচ্ছনা কেনো? তিনি উত্তরে বলেন অবশ্যই দেবো, ওর ঘনকালো চুলগুলো কপালের দিকে একটু রূপালি হয়ে চিক চিক করুক, তখন দেবো। এবং তাই হলো। ২০১৩ সালে এই ক্লাব আমাকে সাংবাদিকতায় সম্মাননা প্রদান করে ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। আরো ঋণী করেন আমাকে সম্মানিত সদস্যপদ প্রদান করে। আমি নারীদের আনন্দবিনোদন আর সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের ঐতিহ্যবাহী এই কেন্দ্রটির উত্তরোত্তর সাফল্য ও মঙ্গল কামনা করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, কারণ এবং করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে প্রাকৃতিক কৃষি বিষয়ক কর্মশালা