বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, কারণ এবং করণীয়

উম্মে সালমা | শনিবার , ৩০ নভেম্বর, ২০২৪ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা সামাজিক জীবনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এটি প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে। বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক চাপে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানসিক স্বাস্থ্যহীনতা কেবল তাদের ব্যক্তিগত জীবনে নয়, পুরো পরিবারের স্থিতিশীলতাতেও প্রভাব ফেলে। তাই এই সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে ভাবা অত্যন্ত জরুরি। সেই বিবেচনায়, বাংলাদেশে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য বেশ জটিল এবং সমস্যাযুক্ত বিষয়ও বটে! যদিও সামপ্রতিক বছরগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে, তবে নারীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা এখনও যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না। পরিবার, সমাজ, এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার চাপ নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সাধারণত কয়েকটি প্রধান বিষয়ে কেন্দ্রীভূত। তার মধ্যে সবচে এগিয়ে আছে দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতা। পরিবারের দায়িত্ব, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, সন্তান লালনপালনের চাপ এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনের সীমাবদ্ধতা নারীদের মধ্যে দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতার জন্ম দেয়। এর পরই রয়েছে ঘরোয়া বা পারিবারিক সহিংসতা। অনেক নারী শারীরিক, মানসিক এবং যৌন সহিংসতার শিকার হন। এই অভিজ্ঞতা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দেয়। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক চাপ। পরিবার ও সমাজ থেকে আরোপিত বিভিন্ন প্রত্যাশা, যেমন ভালো মা‘, ‘ভালো স্ত্রী‘, ‘ভালো মেয়েহওয়ার বাধ্যবাধকতা, তাদের মধ্যে আত্মসম্মানের অভাব তৈরি করে। রয়েছে নানা সাধারণ কিংবা জটিল অসুস্থতায় সঠিক চিকিৎসার অভাব। তদুপরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের বিষয়ে সামাজিক কলঙ্কিত হওয়ার ভয় ও সচেতনতার অভাব নারীদের চিকিৎসা থেকে দূরে রাখে।

এখন, এই যে সমস্যাগুলোর কথা আমরা বলি বা শুনে থাকি সেসবের জন্য আসলে বিভিন্ন দায়ীপক্ষ রয়েছে। তন্মধ্যে পরিবার একটি বড় জায়গা। আমাদের দেশের বেশিরভাগ পরিবারই নারীদের মতামত, স্বপ্ন এবং আবেগকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। সামাজিকভাবে যৌতুক, বৈষম্য এবং নির্যাতনও মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রয়েছে সমাজ ও সংস্কৃতি’র খাঁড়া। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখার প্রবণতাটি এখনও দারুণ প্রবল। ফলে তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চাপানো বাধ্যবাধকতাগুলো তাদের স্বাধীনতা এবং আত্মবিশ্বাস হ্রাস করে।

এদিকে রাষ্ট্র ও নীতি নির্ধারকগণদের গড়িমসিও আরেকটি পক্ষ। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে রাষ্ট্রিয় পর্যাপ্ত সচেতনতা সৃষ্টি এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা অনেকটাই সীমিত। এছাড়াও এবিষয়ক প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাব, গণমাধ্যমে নারীদের সঠিক উপস্থাপনার অভাবও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় অবদান রাখে।

এহেন পরিস্থিতি, নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন বহুমুখী উদ্যোগ। চাই সচেতনতা বৃদ্ধি। পরিবার, স্কুল এবং কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। বিভিন্ন কর্মশালা ও প্রচারাভিযান চালিয়ে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বোঝানো যেতে পারে। দরকার মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ। সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশপাশি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করাটা এখন সময়ের দাবী। এছাড়াও কৌশলগত শিক্ষাসহ জীবনদক্ষতা ও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান করতে হবে। এর জন্য চাই আইন ও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন। যেমন মেয়েদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল পর্যায় থেকে ঘরোয়া সহিংসতা প্রতিরোধ এবং নারীদের অধিকার রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও পরিবারের ভূমিকা এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। আমাদের পরিবারগুলোকে বোঝানো প্রয়োজন যে নারীদের মানসিক সুস্থতা সমগ্র পরিবারের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সমর্থনমূলক পরিবেশ নারীদের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে। পাশপাশি গণমাধ্যমেরও একাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। নারীদের নিয়ে নেতিবাচক ধ্যানধারণা পরিবর্তন করতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম একটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো দীর্ঘমেয়াদি এবং বহুমুখী। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই সমস্যার সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা কেবল তাদের জীবনমানই উন্নত করবে না, বরং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বড় ভূমিকা রাখবে। তাই নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি সমৃদ্ধ এবং মানবিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্যোগ কাটিয়ে ভাণ্ডারি মুলা চাষে ব্যস্ততা
পরবর্তী নিবন্ধলেডিস ক্লাব ঐতিহ্য ও আস্থায়