হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি : দেশভাগের আখ্যান

এস ডি সুব্রত | শুক্রবার , ২৯ নভেম্বর, ২০২৪ at ৯:৩৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলা ছোটগল্পের রাজপুত্র বাংলা কথাসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র হাসান আজিজুল হক। রাঢ়বঙ্গের রূপকার এই কথাসাহিত্যিক তাঁর অনন্য বর্ণনাশক্তির জন্য বিখ্যাত । যার দু’হাতে আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন অসংখ্য মননশীল ছোটগল্প। পাঠকের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ২০০৬ সালে বাজারে আসে তাঁর উপন্যাস ‘আগুনপাখি’। মা, পরিবার, পরিচিত গণ্ডি নিজের জীবনের খুব ঘনিষ্ঠ ছবি আছে হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি উপন্যাসে । বর্তমান পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক সাধাসিধে গৃহবধূ তার বাল্য থেকে বৃদ্ধাপ্রায় জীবনের ছোটবড় ঘটনাগুলো নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় নিতান্ত সরল ভাবনাতেই বর্ণনা করেছেন এই উপন্যাসে। অবশ্য ভাবনা তার শেষ পর্যন্ত সরল থাকে নি, জীবনের ঘটনাপ্রবাহগুলো সরল থেকে জটিল এবং জটিলতর রূপ নিয়েই তবে শেষ হযেছে। হাসান আজিজুল হক একেবারে ব্যক্তিগত যাপিত জীবনের থেকে বাস্তব রস সংগ্রহ করে একজন নারীর বয়ানেই তা প্রকাশ করেছেন। এই নারীটি এবং নারীটির চারপাশের মানুষ ও মানুষের জীবন যে লেখকের নিজের জীবন ও পরিবারের খুব কাছের তা উক্ত কাহিনী এবং লেখকের জীবনের দিকে তাকালে সহজেই অনুমান করা যায়। কাহিনীটি বর্ধমান জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত একটি মুসলিম পরিবার ও পরিবারের আশেপাশের হিন্দুমুসলমানদের জীবন থেকে নেওয়া। কথক, তথা কেন্দ্রীয় চরিত্রটিতে হাসান আজিজুল হকের জন্মস্থান বর্তমান পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার জবগ্রামে। তার বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই, বউবাচ্চাসহ বিরাট যৌথ পরিবার। তিনি নিজেও পার্টিশনের ভুক্তভোগী। নিজের গ্রাম থেকে স্কুলের পড়া সাঙ্গ করে তাকে চলে আসতে হয়েছিলো এপারবাংলায়। লেখক ব্যক্তিগত যাপিত জীবন থেকেই জীবনরস সংগ্রহ করেছেন, এবং গ্রাম্য নারীর বয়ানে শুনিয়েছেন পুরো উপন্যাসে । সততায়, পবিত্রতায় আর ক্ষুরধার চরিত্র রূপায়নে আগুনপাখি হয়ে ওঠে এক অতুলনীয় মানবিক উপন্যাস । ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটি যখন হাসান আজিজুল হক লিখলেন তাঁর জীবনের সাতষট্টিটি বসন্ত পার করে। কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা প্রচ্ছদে সন্ধানী প্রকাশনী থেকে দ’ুশো চব্বিশ পৃষ্ঠায় বেরোলো উপন্যাসটি, অল্প সময়েই তা সাড়া ফেললো সর্বত্র। চার মাসের মধ্যে প্রকাশিত হলো বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ। আগুন পাখিকে দৈনিক প্রথম আলো দিলো ১৪১২এর বর্ষসেরা গ্রন্থের স্বীকৃতি। আবার দুই বছর পরে ২০০৮ সালে এই বইই এনে দিল আনন্দ পুরস্কার। এ উপন্যাসের মূল চরিত্র একজন গ্রাম্য নারী। তিনিই উপন্যাসের কথকচরিত্র । আর দশজন গ্রাম্য নারীর মতো চার দেয়ালের মাঝেই আবদ্ধ যার জীবন। তিনি একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে এবং বিরাট একান্নবর্তী পরিবারের গৃহবধূ। তার স্বামীরা পাঁচ ভাই, তাদের বউছেলেমেয়ে এবং একটি বাল্যবিধবা বোন নিয়ে শ্বশুরবাড়ির বিরাট সংসার। সেখানে নতুন স্বামীকে নিয়ে যেমন স্বল্পবয়স্কা মেয়েটির মুগ্ধতার শেষ নেই । কাছ থেকে সে দেখে সংসারের ক্রমোন্নতি, ধনেজনেমানেশস্যেসম্পদে ধীরে ধীরে পরিবারটির শ্রীবৃদ্ধি। তুমুল সুখের মধ্যে হঠাৎ শোনা যায় বিশ্বযুদ্ধের রণভেরী। টান পড়ে নিত্যকার প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির যোগানে। এর মধ্যেই একসময় দেখা দেয় কলেরাবসন্তের প্রাদুর্ভাব। পরপর দু’বছর ফসলহানি হয়একবার খরায়, তো আরেকবার অতিবৃষ্টিতে। নিয়তির করাল গ্রাসে সেই একান্নবর্তী পরিবারই ভেঙে হয় ছত্রখান, দুর্ভিক্ষের আক্রমণে পারস্পরিক সমপ্রীতি ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক দ্রুত শেষ হয়ে প্রকট হয় স্বার্থের নগ্নরূপ। সেই আকাল কাটতে না কাটতেই আসে নতুন আরেক সমস্যা। ভ্রাতৃপ্রতিম হিন্দু মুসলমান অবতীর্ণ হয় ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বে। যারা এতদিন পরস্পরের পাশে দাঁড়িয়েছে বিপদে আপদে, তারাই রামদা, ছুরি নিয়ে লিপ্ত হচ্ছে মারামারিতে। ভ্রাতৃত্বের পরাজয় হয় সামপ্রদায়িকতার কাছে । ভাগ হয় ভারতভূমি। উপন্যাসের শেষে কর্তা পরিবারটি নিয়ে পাড়ি দিতে যান পাকিস্তানে, কিন্তু সবাইকে অবাক করে বেঁকে বসেন পরিবারের বধূ । তিনি থেকে যেতে চান শ্বশুরবাড়ির ভিটেতেই। স্বামীর রক্তচক্ষু, পুত্রকন্যার আবেগবিহ্বল অশ্রুকিছুই নিরস্ত করতে পারে না তাকে। দেশভাগের ভ্রান্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে নিজের অজান্তেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তিনি। এই প্রতিবাদ কেবলই নিজের জন্য, আপন অস্তিত্বের জন্যে। এভাবেই একটি পরিবারের উত্থানপতনের ভেতর দিয়ে লেখক আঁকেন গোটা সমাজের উত্থানপতনের চিত্র। ‘আগুনপাখি’র কাহিনী বর্ণনায় আমরা স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট খুঁজে পাই ভাষা বিন্যাসের ক্ষেত্রে । সম্পূর্ণ উপন্যাসটিই লিখিত হয়েছে রাঢ়বঙ্গের আঞ্চলিক ভাষায়। পাঠক যদি একবার এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন তবে পাঠক উপলব্ধি করবেন আঞ্চলিক ভাষার শক্তিও কত প্রবল হতে পারে। এক গ্রামীণ মুসলিম পরিবারের জীবনপ্রবাহে উত্থানপতনের বিবরণ দিতে গিয়ে সেখানকারই বৌঝিদের কথ্যভাষায় এই রচনা শুধু লেখকের সাহসিকতারই পরিচয় দেয় না, বরং মাটির সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগের কথাও পাঠককে জানিয়ে দেয় । ‘আগুনপাখি’ মূলত গ্রামীণ মুসলিম পরিবারের আড়ালে সাতচল্লিশপূর্ব অখণ্ড ভারতের উত্থানপতন, তদানীন্তন রাজনীতি, বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ ও সামাজিক অবক্ষয়ের আখ্যান। সংসারের সবাইকে নিয়ে একসাথে বসে খেতে যে অনুভব করে স্বর্গীয় সুখ, আবার একান্নবর্তীর মায়ার দেয়াল ভেঙে ভাইদের হাঁড়ি আলাদা হলে বুকের ভেতর শুনতে পায় করুণ হাহাকার। উপন্যাসের শুরুতে তাকে আমরা পাই অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যাওয়া একটি সাধারণ মেয়ের ভূমিকায়; আশাআকাঙ্ক্ষা, মানঅভিমান, স্বপ্নসুখের সমন্বয়ে এক অতি সাধারণ গ্রাম্য নারীর চরিত্র।

হিন্দুমুসলিম সামপ্রদায়িক দাঙ্গা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ অতঃপর সাতচল্লিশের দেশবিভাগের মতো ভয়াবহ ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে অনেক মুসলিম পরিবারের পশ্চিম বাংলা থেকে পূর্ব বাংলায় আগমন এবং অগণিত হিন্দু পরিবারের পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় গমন আমাদের ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ও স্বাভাবিক সত্য। আগুনপাখিতেও সেই চিত্রই ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক সুনিপুণভাবে ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছায়ামানুষ, ছায়াসময়
পরবর্তী নিবন্ধসিআইইউতে আইআইটিআইআরের উদ্বোধন এবং সনদ বিতরণ