স্বাধীনতা পরবর্তী যে সরকারগুলো বাংলাদেশ শাসন করেছে তা সবই তাগুত সরকার, মুনাফেক সরকার। এদের কেউ আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান শাসন করার কোন ব্যবস্থা তো নেয়নি আর যারা এই বিধান, এই শাসন এই জমিনে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে মেহনত করেছেন তাদের উপর চলেছে ইতিহাসের ভয়াবহতম নিষ্ঠুর নির্যাতন, নিপীড়ন, অত্যাচারের ষ্টিম রোলার। ডান্ডাবেড়ী পরিয়ে, হাতকড়া পরিয়ে অন্ধকার জেলখানায় নিয়েছিল বরেণ্য ইসলামিক স্কলারদের। আল্লাহর কোরআনের বাণী উচ্চারণ করার অপরাধে বছরের পর বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিনাতিপাত করেছিল কোরআনের পাখিগুলো। অবশেষে স্বৈরাচারের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পায়নি মর্দে মুজাহিদেরা। শাহাদাতের পেয়ালা পান করে চলে গেছেন মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে। তেপ্পান্নটি বছর বাংলার আকাশ বাতাস ছিল তাগুত শক্তিতে ভরপুর। তাগুত–এটি অত্যন্ত ঘৃণিত একটি শব্দ। এটি এসেছে ‘তাগা’ থেকে। তাগা শব্দের অর্থ সীমালঙ্গন করা,‘অতঃপর যে ব্যক্তি সীমালঙ্গন করেছে এবং দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, অবশ্যই জাহান্নাম হবে তার আবাসস্থল; যে ব্যক্তি তার মালিকের সামনে দাঁড়ানোর (দিনটিকে) ভয় করেছে এবং নিজের নফসকে কামনা বাসনা থেকে বিরত রেখেছে, অবশ্যই জান্নাত হবে তার অনন্ত ঠিকানা’– সূরা আন নাজেয়াত– ৩৭–৪০। বাংলার জমিনে এই তাগুত শক্তি বারবার এসেছে। তারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শাসন কায়েম তো করবেই না বরং যারা করার মেহনতে লিপ্ত তাদেরকে বাধা প্রদান করবে প্রচন্ডভাবে। তাদেরকে নিগৃহীত করবে, নির্যাতন করবে, এমনকি হত্যা করার মত অগণিত ঘটনা ঘটেছে এই দেশে। কাফের অর্র্থাৎ অস্বীকারকারী–তারা আল্লাহকে অস্বীকার করবে, আল্লাহর বিধানসমূহকে অস্বীকার করবে কিন্তু যারা আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করতে চায় তাদেরকে বাধা প্রদান করবে না। তাগুত ও কাফেরের মধ্যে এই হল বেসিক পার্থক্য। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা শাসন করেছে কয়েকটি সরকার–৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ৭৬ থেকে ৮১ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, ৮২ থেকে ৯০ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি, ৯১–৯৬ পর্যন্ত আবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, ৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জোট সরকার, ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত তত্বাবধায়ক সরকার, ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত দীর্ঘকালীন সময়ে ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার। এই সরকারগুলো ২০০ বছরের পুরানো ব্রিটিশ আইন দ্বারা শাসন করেছে এই বাংলাদেশ। প্রতিটি অপরাধের শাস্তি ছিল মানব রচিত মতবাদ দিয়ে গড়া সংবিধান কর্তৃক। আল্লাহর সংবিধান ছিল এখানে অসহায়, আল্লাহর কোরআন ছিল এখানে মজলুম। কোরআনের একটি আয়াত দিয়ে এদেশের আইন–কানুন রচিত হয়নি কস্মিনকালেও। মানবগড়া মতবাদ দিয়ে রচিত সংবিধান দিয়ে যে আইন প্রবর্তিত ছিল তা ছিল কোরআন–সুন্নাহ বিরোধী। যার ফলে তেপ্পান্ন বছরেও দেশ থেকে চিরতরে নির্মূল হয়নি দুর্নীতি, অপশাসন, খুন, গুম, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ধর্ষণ, দখলবাজি; বরং দিন দিন বেড়ে চলেছে ইতিহাসের বর্বরতম ঘটনা প্রবাহ। আর অসহায় মানবতা কালের পর কাল প্রহর গুণে সু–বিচারের আশায়, ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষায় কিন্ত সেদিন আর আসে না, আর আসবেও না। কারণ এখানে আল্লাহর কোরআনের অনুপস্থিতি দুঃশাসনের পাহাড় জমে যেন উপচে পড়ছে। অপকর্মগুলোর একটি ঘটনাও যদি আল্লাহর আইন দ্বারা বিচারকার্য পরিচালনা হত তবে কেউ দুঃসাহস দেখাত না এই ঘটনা পুনরায় করার। যেমন: চুরির সাজা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হাত কাটা, ‘পুরুষ ও নারী–এদের যে কেউ চুরি করবে তাদের উভয়ের হাত কেটে ফেল, এটাই তাদেরই কর্মফল, আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত দন্ড’– সূরা মায়েদা– ৩৮। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা না করলে তাদের অবস্থা যে কত ভয়াবহ তা আল্লাহর কোরআন থেকে বুঝা যায়, ‘যারা আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না, তারাই হচ্ছে জালেম, কাফের, ফাসেক’ – সূরা মায়েদা– ৪৪, ৪৫ ও ৪৭। আজ পৃথিবীর সর্বত্র তাগুতের বিধান চালু রয়েছে, ফলে বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান তো হচ্ছেই না বরং পাহাড়সম সমস্যা জিইয়ে রেখেছে পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। পৃথিবীতে বর্তমানে কয়েকটি যুদ্ধ বিদ্যমান রয়েছে। কোথাও নিজেদের আধিপত্যের লড়াই আবার কোথাও হক–বাতিলের লড়াই। বিশ্বের জুলুমবাজ সন্ত্রাসী রাষ্ট্র আমেরিকার আসকারা পেয়ে নেতানিয়াহু প্রশাসন যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। তাদের লাগাম টেনে ধরার যেন কেউ নেই, তাগুত ও কুফরি শক্তির কারণে পৃথিবীর অনেক দেশের মুসলিমরাই নিগৃহীত ও অপমানিত হচ্ছে। বিশ্বনবী কোরআন দিয়ে মদিনা রাষ্ট্র শাসন করেছেন দশটি বছর। মদিনায় তখন চারটি ধর্মের সহাবস্থান বিদ্যমান ছিল। তাদের উপর কোন অযাচিত হস্তক্ষেপ হয়নি এই দশটি বছর। তাদের উপর হয়নি কোন জুলুম। তারা ইসলামি রাষ্ট্রের মহান আমানত। তাদেরকে হেফাজত করা ও নিরাপত্তা দেওয়া ইসলামি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সেই মদিনা সনদ দিয়ে যদি পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো পরিচালিত হত তাহলে প্রতিষ্ঠিত হত আইনের শাসন, সৎ শাসন ও সুষ্ঠু প্রশাসন কিন্তু ১৪০০ বছর পর সেই মদিনার সনদ এখনও কোন রাষ্ট্রেই বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। যদিও দু’ একটি রাষ্ট্রে আল্লাহর কোরআনের কিছু বিধান চালু আছে। বাংলার প্রতিটি ইঞ্চি মাটির উপর আল্লাহর শাসন যদি প্রবর্তন না হয় তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না, জুলুম বিতাড়িত হবে না, খুন, ধর্ষণ কোনদিনই বন্ধ হবে না। যারা এই আইন প্রবর্তন করার ক্ষেত্রে অন্তরায় তারাই হচ্ছে তাগুত। আর এই তাগুত শক্তিগুলো ভোল পাল্টিয়ে বিভিন্নভাবে এদেশের নিরীহ জনগণকে প্রতারিত করে আসছে তেপ্পান্নটি বছর। যারা কোরআনের শাসনকে এদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করবে তাদেরকে কাল কেয়ামতের মাঠে আরশে আজিমের মালিকের কাছে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে।
বরেণ্য আলেম ওলামাগণ কিংবা সাধারণ ছাত্র জনতা যারাই আল্লাহর কানুন প্রবর্তন করার এই মহান কর্মযজ্ঞে মেহনত করে যাচ্ছে, আবহমানকাল থেকে তাদেরকে শাসকগোষ্ঠী বার বারই আঘাতের পর আঘাত করেছে, নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছে। তাদেরকে হত্যা করে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছে। এর পরও থেমে থাকেনি এই শাসন প্রবর্তনের মহৎপ্রাণ মানুষগুলোর চেষ্টা আর যারা আল্লাহর বিধান কায়েম করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকে সার্টিফাই করেছেন আল্লাহতায়ালা এভাবেই, ‘ যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের তোমরা কোন অবস্থাতেই মৃত মনে কর না, তারা তো জীবিত–তাদের মালিকের কাছ থেকে রীতিমত রেজেক দেওয়া হচ্ছে’– সূরা– আলে ইমরান–১৬৯। আবার অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছেন তাদের তোমরা মৃত মনে কর না বরং তারাই হচ্ছে জীবিত, কিন্তু তোমরা কোন চৈতন্যই রাখ না’– সূরা বাকারা–১৫৪। অতএব আল্লাহর বিধান যদি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কেউ বাধা প্রদান করে তাদের শাস্তি দুনিয়াতে তো আছেই, আখেরাতে হবে কঠিন থেকে কঠিনতম আর তখন তাদের সাহায্য করার মত কেউ থাকবে না। তারা আল্লাহর প্রজ্বলিত আগুনে জ্বলতেই থাকবে অনন্তকাল। আর যারা আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মেহনত করেছে এবং এতে জালিম শাসক কর্তৃক শহীদ হয়েছেন তারা জান্নাতের উচ্চ আসনে সমাসীন হবেন। আমিন।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল