সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে নিজ গ্রাম লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের ফারেঙ্গা গ্রামে দাফন করা হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রাম নগরে দুই দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল সকাল ১০টায় আদালত পাড়ায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সাড়ে ১১টায় নগরীর জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর নগরীর নিউমার্কেট মোড়ে গায়েবানা জানাজার পর সাইফুল ইসলাম আলিফের গ্রামের বাড়িতেও দুই দফায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব জানাজায় বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার লাখো মানুষ অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে আদালত পাড়া ও জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণ জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
আদালত পাড়ার জানাজায় অংশগ্রহণ করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফ, জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, মহানগর দায়রা জজ মো. সাইফুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মিজানুর রহমান, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সহিদুল ইসলামসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদালতে কর্মরত বিচারকরা। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মো. আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক, পরিষদের কর্মকর্তা ও নির্বাহী সদস্যরা। আরো উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম আদালতে আইন চর্চায় নিয়োজিত নিহত সাইফুল ইসলামের হাজারো সহকর্মী ও আদালতের কর্মকর্তা–কর্মচারীসহ সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক মানুষ।
জানাজা শেষে উপদেষ্টা হাসান আরিফ আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীকে দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, অবিলম্বে উক্ত ন্যক্কারজনক ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারপূর্বক বিচারের আওতায় আনা হবে। তিনি সাইফুল ইসলাম আলিফের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা ও শোক জ্ঞাপন করেন।
আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ভিকটিম আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকারীদের পক্ষে কোনো আইনজীবীকে মামলা পরিচালনা না করতে অনুরোধ জানান এবং এ বিষয়ে শীঘ্রই সমিতির সভা আহ্বান পূর্বক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে মর্মে জানান। আইনজীবী সমিতির ইতিহাসে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা পূর্বে কখনই হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসকনের সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক বলেন, ইসকন একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, তারা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তারা প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে আদালত ভবনে হামলা চালিয়ে নিরীহ বিচারপ্রার্থী জনগণের ওপর হামলা করেছে। শুধু তাই নয় তারা কোর্টহিল জামে মসজিদে ভাংচুর চালিয়েছে। আইনজীবীদের চেম্বারে আক্রমণ করেছে। শত শত গাড়ি ভাংচুর করেছে। দোকানপাটে হামলা ও লুটতরাজ করে ত্রাস সৃষ্টি করেছে। তিনি অবিলম্বে খুনীদের গ্রেপ্তারপূর্বক দ্রুত বিচারের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানান।
নগরীর জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত নামাজে জানাজায় অংশগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান, চট্টগ্রাম মহনগরী জামায়াতের আমির সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও আরেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম।
ডা. শাহাদাত হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, হামলাকারী যেই হোক, যে দলেরই হোক, যে বর্ণের হোক– সন্ত্রাসী সন্ত্রাসীই। সন্ত্রাসীর কোনো ধর্ম নেই, কোনো দল নেই। সন্ত্রাসীকে আমরা সন্ত্রাসী হিসেবে ট্রিট করব। অনতিবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আর ধর্মকে ব্যবহার করে কোনো খুনি আসামি, দাগী সন্ত্রাসী কেউ যাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কোনো অন্যায় কাজ করতে না পারে। আমরা চাই না ওই কতিপয় সন্ত্রাসীর কারণে সাধারণ সনাতনী কিংবা অন্য মানুষ এখানে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হোক। সেটাও আমরা চাই না। শাহাদাত বলেন, আমরা একটি শান্তিপূর্ণ নগরী চাই, একটি নিরাপদ নগরী চাই। যেখানে সন্ত্রাস থাকবে না, যেখানে বৈষম্য থাকবে না, যেখানে নৈরাজ্য থাকবে না, যেখানে হত্যাকাণ্ড থাকবে না। আজ থেকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ওই সব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাই মিলে সম্প্রীতি বজায় রাখব।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান বলেন, তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তা অত্যন্ত জঘন্য এবং নিন্দনীয় অপরাধ। একটি গোষ্ঠী পতিত স্বৈরাচারের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশকে অস্থির করার জন্য ক্রমাগতভাবে দূরভিসন্ধি ও অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অস্থির করে তুলতে চায়। দেশপ্রেমিক জনগণ তাদের দূরভিসন্ধির ব্যাপারে পরিপূর্ণ সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ। তাদের অপচেষ্টা অতীতেও ব্যর্থ হয়েছে, আগামীতেও ব্যর্থ হবে ইনশাআল্লাহ।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও চট্টগ্রাম মহনগরী জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ইসকনের সন্ত্রাসীরা তরুণ এই আইনজীবীকে আদালত চত্বর থেকে তুলে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। সাইফুল ইসলাম ন্যায়ের পথে লড়েছেন। সত্যের পথে লড়েছেন। সত্যের কাছে পরাজিত হয়ে ইসকন সন্ত্রাসীরা আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে কুপিয়ে শহীদ করেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং জনসাধারণকে শান্ত থাকার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইসকনকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ইসকন কিভাবে আমার ভাইকে শহীদ করেছে তা আপনারা দেখেছেন। বাংলার পলাতক ডাইনি হাসিনা ভারতে বসে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। আওয়ামী লীগের এই স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হবে না। ইসকন উগ্র সন্ত্রাসী ও জঙ্গী গোষ্ঠীকে অবিলম্বে বাংলাদেশ থেকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এদেশে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের সুযোগ দেওয়া হবে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, বাংলাদেশের মুসলমানরা অন্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল। আর এই সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এডভোকেট সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাদের আর নিস্তার দেওয়া হবে না। বিগত খুনি হাসিনা তিলে তিলে এই জঙ্গী সংগঠন ইসকনকে প্রতিষ্ঠা করেছে। অবিলম্বে আইনজীবী সাইফুলের খুনিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।