চট্টগ্রাম আদালতে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মুক্তির দাবি ঘিরে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যার প্রতিবাদে গতকাল দিনভর উত্তাল ছিল চট্টগ্রাম নগরী। দিনব্যাপী নানা বিক্ষোভ কর্মসূচি আর নানা স্লোগানে উত্তপ্ত হয়ে উঠে নগরীর সড়কগুলো। এ সময় ইসকনকে নিষিদ্ধ এবং শীঘ্রই এডভোকেট সাইফুল হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।
এদিন বেলা ১২টায় টাইগারপাস এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলমের নেতৃত্বে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে শোক ও সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্যে হাসনাত আবদুল্লাহ ধর্মের দোহাই দিয়ে উগ্রবাদী সংগঠন পরিচালনা করলে বাংলাদেশে কোনো জায়গা হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এছাড়া সহানুভূতিকে দুর্বলতা মনে করলে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে না বলে মন্তব্য করেন সারজিস আলম। এর আগে সকাল ১১টায় নগরীর জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে সাইফুল ইসলাম আলিফের দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে লাখো মানুষের ঢল নামে। দেশের বিভিন্ন জায়গা লোকজন জানাজায় অংশ নেন। জানাজাস্থল থেকে হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল নিয়ে নগরীর টাইগারপাস মোড়ে গিয়ে শোক ও সম্প্রীতি সমাবেশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর আগে সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে প্রথম জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাইফুল ইসলামের সহকর্মী আইনজীবীরা অংশ নেন। সাইফুল হত্যার ঘটনায় গতকালের মত আজও বন্ধ থাকছে চট্টগ্রাম আদালতের কার্যক্রম।
শোক ও সম্প্রীতি সমাবেশ : অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে নগরের টাইগার পাস মোড়ে শোক ও সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ থেকে স্লোগান নিয়ে আসেন হাসনাত ও সারজিসসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। এরপর শুরু হয় ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ। এসময় ‘দিল্লী না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘ইসকন জঙ্গী, স্বৈরাচারের সঙ্গী’, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে’, বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলীর সঞ্চালনায় হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম ছাড়াও এতে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রীয় সহ–সমস্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি, চট্টগ্রাম কলেজ শিক্ষার্থী লিজা, ছাত্রশিবির মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ইব্রাহিম রনি, উত্তরের প্রকাশনা সম্পাদক আবরারুর হাসান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রাসেল মাহমুদ এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সম্পাদক।
হাসনাত আবদুল্লাহ তার বক্তব্যে বলেন, আওয়ামী লীগের সহায়তায় ইসকন গত ১৬ বছর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠেছে। এখন জঙ্গী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ভারতের বুবু, ভারতের হাসিনা এই বাংলাদেশে তোমার আর ঠাঁই হবে না। ভারতে বসে যতই ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করা হোক আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ সেই ষড়যন্ত্র রুখে দেব। আমাদের দেশে সব ধর্মের সহাবস্থান থাকবে। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে উগ্রবাদী সংগঠন পরিচালনা করলে বাংলাদেশে তাদের কোনো জায়গা হবে না।
সম্প্রীতি সমাবেশে সারজিস আলম বলেন, যে রক্তের বন্যা বইয়ে শেখ হাসিনা এই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, যে রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে নতুন বাংলাদেশ এসেছে, সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এই চিন্ময়রা উসকানি দেয়; সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে খুনি হাসিনা উসকানি দেয়; সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে জঙ্গী ইসকনরা উসকানি দেয়; সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ভারতের কিছু প্রেতাত্মা উসকানি দেয়। আমরা স্পষ্ট করে সব প্রেতাত্মাদের বলে দিতে চাই, আমরা ১৬ বছরের স্বৈরাচার খুনি হাসিনাকে দেশ ছাড়া করেছি। ছোটোখাটো কিছু জঙ্গী ইসকনকে দেশছাড়া করা আমাদের জন্য বাম হাতের খেল। তিনি বলেন, আমরা সকল ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু কেউ যদি আমাদের সহানুভূতিকে দুর্বলতা মনে করে আমরা তাদেরকে ছেড়ে দেব না। আমরা কি এই জঙ্গী ইসকনকে ছেড়ে দেব? আমরা আমাদের সাইফুল ভাইয়ের খুনিদের বিচার দেখতে চাই। বীর চট্টলাবাসী আপনাদেরকে বলে দিতে চাই– আমাদের চারপাশে অনেক চক্রান্ত ছিল, আরও চক্রান্ত হবে, কিন্তু আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে সকল চক্রান্ত প্রতিহত করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, প্রশাসনের যেসব জায়গায় স্বৈরাচারের দোসররা বিরাজমান, তাদের নির্মূল করতে হবে। আমরা বলতে চাই, ভারতীয় প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশ চলবে না; ভারতীয় কোনো আগ্রাসন বাংলাদেশে চলবে না; ভারতীয় কোনো দাদাগিরি বাংলাদেশে চলবে না। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে এক ও ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু যদি কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তাহলে আমরা বাংলাদেশের ছাত্রজনতা তাদের প্রতিহত করতে একবারও ভাবব না।
এসময় ইসকনকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে রাসেল আহমেদ বলেন, আমাদের এই বাংলাদেশে কোনো উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের ঠাঁই হবে না, কেউ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। এই বাংলাদেশে ইসকনকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আমরা ১৫ দিনের মধ্যে ইসকনকে নিষিদ্ধকরণ চাই। ইসকনের সন্ত্রাসীরা আমাদের ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমরা এর বিচাই চাই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে ফাঁসিতে ঝুলাতে হবে।
এদিকে গতকাল জুলাই গণহত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে চট্টগ্রাম মহানগর ইসলামী ছাত্রশিবিরি। বিকেল ৩টায় নগরের বহদ্দারহাট থেকে বিশাল মিছিল শুরু হয়ে ২ নম্বর গেইটে এসে সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। এ সময় বক্তব্য রাখেন ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক আজিজুর রহমান, কেন্দ্রীয় প্লানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেক্রেটারি ডা. ওসামা রাইয়ানসহ চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর–দক্ষিণের সভাপতি, সেক্রেটারি, চবি সভাপতি প্রমুখ।