সময়টা বর্ষাকাল। কয়েকদিন ধরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছিল।
বর্ষার কুয়াশাচ্ছন্ন দুপুর বেলায় বাড়িতে সবাই ঘুমুচ্ছেন।
এই সুযোগটা হাতছাড়া করা যাবে না। দিপুদের বাড়ির সামনে মস্তবড় একটা পেঁয়ারা গাছ। গাছের ডালে সবুজ হলুদে টকটকে পাকনা পেঁয়ারা। পেঁয়ারা দ্যাখে জিহবা জল এসে গেলো।
আর লোভটা সামলাতে পারলাম না। গাছের তলা দিয়ে যেতেই গাছের নিচে কয়েকটি পেয়ারা ঝরে পড়ল। দিপুকে বললাম। আমি গাছে উঠি।
তুই নিচে দাঁড়িয়ে থাক। আমি বললাম তোর গাছে ওঠার দরকার নেই। দিপু বলল, ঠিক আছে আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি। কাউকে দেখলে তোকে জানান দেব।
দিপু তার বাবার শব্দ শুনে দৌড়ে পালাল। হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় শুরু হলো। বেশকিছুক্ষণ আমি গাছে আটকে যাই।
বাড়িতে যখন ফিরলাম ” মা রেগে বলে, বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হলে তখন কি হবে। বর্ষাকাল আসলে মায়ের কথা বড্ড মনে হয়।
বর্ষাকালে মা একেবারেই ইশকুলে যেতে দিতেন না। ইশকুলে না গেলে আমার কিছুই ভালো লাগে না।
মা–জানে, বৃষ্টিতে আমি বাচ্চাদের মতো ভিজি। মাকে কি করে বুঝাই, বৃষ্টিতে একটু ভিজলে তেমন কিছু হয় না।
মায়ের খুব ভয়, আমার যদি আবার কোন অসুখ বিসুখ হয়।
তাই মা ইশকুলে যাবার সময় আমাকে রাগ করে গাড়ি ভাড়া দেয়নি। মা মনে করছে সেদিন আমি আর ইশকুলে যাবো না।
মা তো কাজে ব্যস্ত সে সুযোগে আমি ইশকুলের পথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎ করে ঝুম বৃষ্টি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া সত্যি কষ্টকর। এমন সময় এক অচেনা চাচা আমার মাথায় ছাতা ধরে বলেন, এই যে খুকী তোমার নাম কী? বৃষ্টিতে ভিজে ইশকুলে যাচ্ছ ক্যান?
তোমার তো শরীর খারাপ হতে পারে। আমি ভালো মন্দ কিছু বললাম না। আমি তো জানি। আমি ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজছি। চাচা ইশকুলের নাম জানতে চাইলো। আমি এবারো চুপ করে রইলাম। তিনি একটা রিকসা ডাকলেন! আমাকেও বসতে বললেন।
আমি চুপচাপ তার পাশে বসলাম ।
যেতে যেতে মাঝ পথে ভাবলাম। আমি কি কাজটা ঠিক করেছি। অচেনা একজন লোকের সাথে রিকসাতে বসলাম। যদি লোকটা ছেলেধরা হয়।
যাক, আমার ভেতরে অনেক সাহস। আমি তো আর ভীতু না। ইশকুলে না নিয়ে অন্যপথে নিলে লাফ দেব গাড়ি থেকে, মনে মনে ভেবে রাখি।
লোকটা দেখি চন্দপুরা রাস্তার দিকে যাচ্ছে। আমার ইশকুলের নাম আবারও জানতে চাইলো? এবার উত্তর দিলাম। আমি যে ইশকুলে পড়তাম সেটা চট্টগ্রাম কলেজের পাশে, সরকারি ইসকুল। ইসকুলের সামনে আমাকে নামিয়ে দিলেন তিনি। তখন আমি ওই চাচাকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা হারিয়ে ফেলি। আমি তার চলে যাওয়ার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম।
এদিকে মা তো ভীষণ চিন্তিত। আমি কই? ইশকুল থেকে এসে মাকে সবটা খুলে বলি।
মা বলে পৃথিবীতে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছে রে মা” মা…. ।
রোজ রাতে মা ‘ আমাকে এবং ভাইদেরকে নিজ হাতে দুধ গরম করে খেতে দিতো?
বুয়া বা অন্য কারো হাতে দিতো না। মা নিজ হাতে গ্লাস ভরে দুধ নিয়ে আসে আমাদের রুমে। মায়ের জন্য আর বড়ো হতে পারলাম না মনে হতো।
হঠাৎ করে মায়ের শরীরটা অসুস্থ হয়ে যায়। দিন যায়,মাস যায়,বছর যায়,মা আর সুস্থ হয় না।
একদিন মা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান আমাদের ছেড়ে।
মা নেই। সেটা ভাবতেই ছোট্ট বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠে। মা…..আগের মতো উঁকি দিয়ে দেখে না আমার রুমে, আমি কি পড়ছি না পড়ছি। কি খাচ্ছি, খাচ্ছি না।
মা, আর রাত হলে আর দুধের গ্লাস নিয়ে আসে না। বারবার দুধ খেতে নিলে মায়ের কথা মনে হয়। মায়ের সুমধুর স্মৃতিগুলো অন্তরে প্রশান্তির দীপ্তি ছড়ায়।
আমি খুব চঞ্চলা ছিলাম। পাখির ডানার মতো উড়তাম। সবুজ কচি ঘাসগুলো ছুতাম। প্রকৃতির বুকে এক মুটো স্বপ্ন এঁকে দিতাম। মেঘের লুকোচুরির সাথে উড়ে যেতাম মনের সুখে। খেলাধুলা, পুতুলবিয়ে সারাদিনের ব্যস্তময় সময়গুলো কিভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত গড়িয়ে যেতো। খেলাধুলার পাশাপাশি অনেক দুষ্টমি করতাম, মা তেমন বকাঝকা দিতেন না। এইভাবে কড়া নিয়মের মধ্যে আমার জীবন কেটে যেতো! মাকে আমার জন্য সবাই কত বকা দিতেন। বলতেন, তোমার রাজকন্যাকে মাথায় তুলে রেখো না। অতিরিক্ত আদর প্রশ্রয় দিও না।
মা সবসময় আমার ছোট ছোট, দোষগুলো আড়াল করতেন। মা বলতেন, আমার মেয়ের কোনো দোষ নেই। আমার মেয়েটা কোনো অন্যায় করতে পারে না।
সেসব কথা মনে হলে এখনো কেঁদে ফেলি।
ভাবতে থাকি জীবনটা এতো ছোট কেন? আরো কিছুদিন মাকে কাছে পেতাম যদি। আহা! মনের গহীনে অনেক কথা জমে আছে মাকে বলার জন্য।
মা নেই। ভাবতে নীল বেদনায় তখন আমার কুঁকড়ে ওঠে বুক। এমন কথা মনে হলে চোখে অঝোরে ঝরে পড়ে অশ্রু। কখনো কখনো মায়ের সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা মায়াভরা মুখটা চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে।
মায়ের কথাগুলো বড্ড মনে পড়ে। বৃষ্টির দিনে মায়ের হাতের খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা সে অমৃত স্বাদ আর কোথাও খুঁজে পাই না। মায়ের সাথে বৃষ্টিদিনের সোনালি সময়গুলো ভেবে চোখ ভেজাই!