সংঘর্ষ-ভাঙচুর, আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুরের পর আদালত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘাতে জড়ায় অনুসারীরা । হত্যার প্রতিবাদে আজ আইনজীবীদের আদালত বর্জন

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২৪ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশকে ঘিরে চট্টগ্রাম আদালত পাড়ায় ব্যাপক হাঙ্গামা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে সাইফুল ইসলাম আলিফ (৩৫) নামে এক আইনজীবী নিহত হয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম জজ আদালতের সরকার নিযুক্ত এপিপি। নিহত সাইফুল লোহাগাড়ার চুনতি এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে এবং আইআইইউসির আইন বিভাগের সাবেক ছাত্র। তার আড়াই বছরের একজন শিশুকন্যা রয়েছে। এছাড়া তার স্ত্রী চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। চট্টগ্রাম জজ কোর্টের পাশাপাশি তিনি সুপ্রিম কোর্টেরও আইনজীবী।

গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৪টার দিকে আদালত পাড়ায় প্রবেশ গেটের উল্টো দিকের মেথরপট্টি এলাকায় সাইফুল ইসলাম আলিফের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটে। এ সময় অনেক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক আজাদীকে বলেন, আদালত পাড়া থেকে ধরে মেথরপট্টিতে নিয়ে আমাদের সহকর্মী আইনজীবী সাইফুলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সেই সাথে সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, আমরা মিটিং করেছি। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা কাল (আজ) আদালতের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করব না। আমরা আদালত বর্জন করেছি। কাল (আজকে) সকাল সাড়ে ১০টায় আদালত প্রঙ্গণে আলিফের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। আদালত পাড়ার পাশাপাশি আজ নগরীর নিউ মার্কেট মোড় ও জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে সাইফুল ইসলাম আলিফের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া আজ বাদে আছর চুনতি ইউনিয়নের ফারেঙ্গায় গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

এদিকে আদালত পাড়ার এ সংঘর্ষ কোতোয়ালী মোড় ও লালদিঘি পর্যন্ত ছড়ায়। এতে অনেকে আহত হয়েছেন। চমেক হাসপাতাল ৮ জন ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১৯ জন ভর্তি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

তবে গত রাত ৮টায় সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) কাজী তারেক আজিজ আজাদীকে বলেন, এ ঘটনায় সাধারণ জনগণ ৬ জন ও পুলিশের ১২ জন আহত হয়েছেন। তারা চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সংঘর্ষ, সহিংসতা যাতে আর না বাড়ে সেজন্য অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। তিনি বলেন, একজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের হবে। জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

গত সোমবার নগরীর কোতোয়ালী থানার একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাকে চট্টগ্রাম আনা হয়। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় তাকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলামের আদালতে তোলা হয়। এ সময় আইনজীবীরা তার জামিন চেয়ে আবেদন করেন। আদালত তা নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

এর আগে থেকে আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর অনুসারীরা নানা স্লোগান দিতে থাকেন। তারা তার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন। জামিন নাকচ হওয়ার পর দুপুর ১২টায় পুলিশ চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীকে প্রিজন ভ্যানে তুলে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে অনুসারীরা প্রিজন ভ্যানের গতিরোধ করেন। তারা প্রিজন ভ্যানের সামনে এবং পিছনে শুয়ে পড়েন। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস আড়াই ঘণ্টা প্রিজন ভ্যানেই ছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে, লাঠিচার্জ করে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান কারাগারের পাঠিয়ে দেন। প্রিজন ভ্যানে অবস্থানকালীন হ্যান্ডমাইকে চিন্ময় তার অনুসারীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলেন।

চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান আদালত পাড়া হয়ে কারাগারে যাওয়ার সময় পর্যন্ত আদালত পাড়ায় বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। এতে আইনজীবী ও স্থানীয়রাও জড়িয়ে পড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় কোতোয়ালী মোড়, আদালত পাড়ার সামনের এলাকা ও লালদিঘি এলাকা সন্ধ্যা পর্যন্ত উত্তপ্ত ছিল।

আইনজীবী রেজাউল করিম রনি আজাদীকে বলেন, উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ইসকনের সন্ত্রাসীরা আমাদের এক ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তারা আদালত পাড়ায় তাণ্ডব চালিয়েছে। মসজিদ ভাঙচুর ও মসজিদের ইমামকে মারধর করেছে। সাধারণের ওপর হামলা করেছে। এতে বাধা দিলে আইনজীবীদের ওপরও হামলা করা হয়। আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে আদালত পাড়া থেকে ধরে মেথরপট্টিতে নিয়ে হত্যা করেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ইসকনের সন্ত্রাসীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করতে হবে।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী আজাদীকে বলেন, চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুরের পর তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। কিন্তু তার অনুসারীরা প্রিজন ভ্যান আটকে দেয়। বেশ কয়েক ঘণ্টা এভাবেই ছিল। পরে পুলিশ ওদের লাঠিচার্জ করে তাকে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছিল। এর জেরে তার অনুসারীরা আদালত প্রাঙ্গণের সর্বত্র ভাঙচুর করে চলে যাচ্ছিল। যাওয়ার সময় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে ধরে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে। নৃশংসভাবে কুপিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আলিফের পরিবারের সাথে আলোচনা করে মামলা দায়ের করা হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আদালত পাড়ায় থাকা আইনজীবীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে স্লোগান দেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআইনজীবী হত্যার তদন্তের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার
পরবর্তী নিবন্ধএকদিনের মধ্যে চিন্ময় দাশের মুক্তি দাবি সনাতনী জোটের