বেশ সময় নিয়ে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ সমূহ এবং ভারত – বাংলাদেশ চলমান সম্পর্ক নিয়ে ধারাবাহিক লেখাটি লিখছিলাম। এর মাঝে এমন এমন ঘটনা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে ঘটে যাচ্ছে যেগুলি পাঠকদের সামনে তুলে না ধরতে পারা পাঠকদের কাছে এক ধরনের দায়বদ্ধতার ভারে আক্রান্ত থাকার মত। এ তাড়না থেকেই ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চল নিয়ে লেখাটির সাময়িক বিরতি টেনে কয়েক কিস্তিতে এ লেখাটি লিখছি। এটির আজকে শেষ পর্ব।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং বিশ্ব জনমত কোনো কিছুই ইসরাইলকে গাজায় গণহত্যা পরিচালনা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এ না পারার বা বিশ্ব সম্প্রদায়ের ব্যর্থতার পিছনের কারণ খতিয়ে দেখলে একটি দেশের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে প্রতিভাত হবে সে দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রশ্ন আসে সমস্ত বিশ্ব সম্প্রদায় তথা বিশ্ব জনমতের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন দাঁড়াচ্ছে।
এ প্রশ্নের উত্তর খুব কঠিন নয়। আরব উপদ্বীপকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা আমেরিকার যে ভূ–রাজনীতি, ভূ–কৌশল এবং ভূ–অর্থনৈতিক স্বার্থ তাতে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি মুখ্য ভূমিকায়। একথা অনস্বীকার্য যে বর্ণিত এই তিনটি ভূ’ই একই সূত্রে গাথা। আর এ তিনটি অর্জনে ইসরাইলের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির উপর আমেরিকা ক্রমাগত হামলা পরিচালনা করে যাচ্ছে, এ আক্রমণের মাধ্যমে স্বীয় “ওয়ার ইন্ডাস্ট্রি”কে চাঙ্গা রাখার জন্য একদিকে যেমন অস্ত্রের বাজার সৃষ্টি করা হচ্ছে অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে জনবিচ্ছিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কায়েম রেখে তাদের মার্কিন সর্মথন কামী করে রাখা হয়েছে, এরই সুযোগ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেল গ্যাস ক্ষেত্রগুলির উপর আমেরিকার বড় বড় তেল গ্যাস কোম্পানীগুলির আধিপত্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলিকে ভূত বানিয়ে, মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে এ ভাবেই চলছে আমেরিকার তিন “ভূ” এর খেলা।
এমন খেলার বিপরীতে কিছুদিন আগে আমেরিকান দৈনিক “দি নিউইর্য়ক টাইমস” পত্রিকায় গাজা থেকে ফিরে আমেরিকান ডাঃ ফিরোজ সিদওয়া ৬৫ জন ডাক্তার এবং চিকিৎসা কর্মীর অভিজ্ঞতার আলোকে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এই প্রতিবেদনে এ্যানেসথোলজিস্ট ডাঃ নাদেল ফারাহ উল্লেখ করেন “আমি অনেক শিশুর মৃতদেহ দেখেছি যাদের কাছ থেকে মাথায় গুলি করা হয়েছে, এ রকম গুলি খাওয়া কেউ বেঁেচ গেলেও চিরদিনের জন্য সে বুদ্ধি বন্দী প্রতিবন্ধি হয়ে গেছে”। একই প্রতিবেদনে আরেক আমেরিকান ডাঃ মিমি সাঈদ উল্লেখ করেছেন “আমি ১২ বছর বয়সের কম অনেক শিশুকে দেখেছি যাদের বুকের বাম পাশে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে, এসব শিশুদের কেউ কেউ আমাদের হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেও দুই এক ঘন্টার মধ্যেই তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে”।
এ সমস্ত হৃদয় বিদারক ঘটনার আলোকে আমেরিকান আরেক ডাঃ দুঃখ করে বলেছেন “আমাদের নেতা এবং কৌশল প্রনেতাদের গাজায় কি হচ্ছে তা জানার যে অভাব রয়েছে তা নয়, তারা আমাদের চেয়েও বেশী জানেন, তাদের যা অভাব রয়েছে তা হল তাদের নৈতিকতাবোধ আর মানবতার প্রতি দায়বদ্ধহীনতা। আমাদের নেতারা যখন সামরিক বাজেট প্রণয়ন করেন তখন তারা জানেন এ বাজেট কোথায় কিভাবে ব্যবহার হবে এবং জেনে শুনেই তারা ইসরাইলকে গণহত্যায় সহায়তা দিচ্ছেন”।
ডাঃ নিজাম মাহমুদ, বৃটিশ শল্যবিদ অধ্যাপক। গাজা থেকে ফিরে বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের সামনে তার অভিজ্ঞতার বয়ান দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। “আমি জাতি সংঘের একটি কনভয়ে দক্ষিণ গাজায় পৌঁছি, এটি আয়তনে লন্ডন শহরের প্রায় সমান। এখানে পৌঁছে দেখি পানযোগ্য পানি নাই, বিদ্যুৎ নাই, ওষুধ নাই। অথচ ইচ্ছা করলে এ সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা এখানে করা যায়, অথচ ইসরাইল তা হতে দিচ্ছে না, আকাশে ড্রোন আর ড্রোন উড়ছে, এখানে সেখানে ড্রোন থেকে যখন তখন গুলি ছোড়া হচ্ছে, আহত মানুষরা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসে, আমরা ঔষধের অভাবে ঠিকমত চিকিৎসা দিতে পারি না। হাসপাতালে দক্ষ নার্স নাই তাদের অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছে, অনেকে গ্রেফতার, অনেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়েছে। আমার কাছে অনেক আহত অবোধ শিশুকে আনা হয়েছে, ঠিকমত চিকিৎসা সরঞ্জাম না থাকাতে আমার চোখের সামনে স্বর্গীয় অমন মায়াবী শিশুরা পৃথিবী থেকে অকালে বিদায় নিয়েছে। আমরা প্রতিটি যুদ্ধে দুটি পক্ষের মুখোমুখি হওয়ার কথা জানি, যুদ্ধে একটি ফ্রন্ট লাইন থাকে, এখানে অসহায় গাজার মানুষেরা ইসরাইলী সৈন্যদের ফ্রন্ট লাইন, যখন খুশি গুলি করে তারা ফিলিস্তিনীদের মারছে”।
ফ্রান্সিকা আলবানেজ, ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের বিশেষ রির্পোটিয়ার। আলবানেজ মন্তব্য করেছেন গাজায় ইসরাইলীরা পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।
এ হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া সিনওয়ার’ এর মত সাহসী মানুষেরা নিজেদের স্বকীয়তা, অস্তিত্ব রক্ষায় জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিজের জাতি সত্তাকে ডাক দিয়েছেন জীবন দিয়ে দখলদারিত্বের বিরুদ্বে প্রতিরোধের।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার’ এর কাব্যিক আহবান’এর আজ তৃতীয় পর্ব
আমার অহ্বান
কখনো অস্ত্র সমর্পণ করবেন না।
হাতের পাথর দূরে ছুঁড়ে
ফেলে দেবেন না।
শহীদদের ভুলে যাবেন না।
কখনো স্বাধীনতার স্বপ্ন বিমুখ হবেন না,
যে স্বপ্ন আপনার নায্য।
আমরা এ ভূমিতে বেঁচে থাকব
আমরা বেঁচে থাকব আমাদের
মানুষের হৃদয়ে
আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের মাঝে।
আমি ফিলিস্তিন আপনাদের জিম্মায়
রেখে যাচ্ছি।
আজীবন যে ভূমিকে
আমি ভালোবেসে গেছি।
স্বাধীনতার স্বপ্নের বিশাল এক দায়িত্ব
আমি বয়ে বেড়িয়েছি,
এ দায়িত্ব বহনে আমি
কখনো মাথা নোয়াইনি।
জীবন বিপন্ন হলেও
ভেঙে পড়বেন না।
যে পতাকা কখনো আমরা
ওদের গলার কাঁটা হয়ে
স্বাধীনতার অবিচলতার এক
অবিনাশী জোয়ার সৃষ্টি করুন
এবং এ থেকে কখনো নিবৃত্ত হবেন
না, যতক্ষন না পৃথিবী আমাদের
মাতৃভূমির উপর
আমাদের নায্য অধিকার
স্বীকার করে না নেয়
এবং যতক্ষন না বুঝতে পারে
আমরা শুধু মাত্র একটি সংখ্যা নই
আমরা একটি সত্তা।
১০
লুটিয়ে পড়তে দিইনি
সেটি সগৌরবে বয়ে বেড়াবেন।
আমার রক্তে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের
সাথে একটি সেতুবন্ধ রচনা
করবেন,
যে প্রজন্ম হবে আরো শক্তিশালী।
ভুলে যাবেন না
মাতৃভূমি বলার জন্য একটি
গল্প নয়
বরং বসবাসের জন্য একটি
বাস্তবতা।
আমি জানি প্রতিজন শহীদের
ঝরে পড়া থেকে
হাজারো প্রতিরোধ যোদ্ধা জন্ম নেবে,
আমি জানি স্বাধীনতার উন্মাতাল
আকাঙ্ক্ষার ঢেউয়ে আত্মদানকারী
আমি প্রথম জন নই।
আমি অনিমেষ উন্মুখ হয়ে
দেখে থাকব
স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার ঢেউ
যেন অহর্নিশ আছড়ে পড়ে
শত্রুর দুর্গে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক