স্বাধীনতা কমপ্লেক্স। নগরের কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সংলগ্ন ১৬ দশমিক ৩৭ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে বিনোদন স্পটটি। এখানে আছে দেশের প্রায় সকল ঐতিহাসিক স্থাপনার মিনি সংস্করণ বা রেপ্লিকা। তাই ‘মিনি বাংলাদেশ’ নামেই পরিচিত পেয়েছে থিম পার্কটি। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এ পার্ক পরিচালনা করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ইজারা নিয়ে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান এটি পরিচালনা করে আসছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে বন্ধ আছে এটি। এমন পরিস্থিতিতে নগরবাসীর সুস্থ বিনোদনের চাহিদা মেটাতে আবারও ‘মিনি বাংলাদেশ’ পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চায় চসিক। গত বৃহস্পতিবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে পার্কটি বরাদ্দও চেয়েছ সংস্থাটি। বিষয়টি নিশ্চিত করে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, একসময় পার্কটি সিটি কর্পোরেশন পরিচালনা করত। কর্পোরেশন দায়িত্ব নেয়ার পর পার্কের প্রবেশমূল্য কমানো হয়। কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় পার্কটি নগরবাসীর কাছে সুস্থ বিনোদনকেন্দ্রের ঠিকানা হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে বেসরকারি খাতে পার্কটি চলে গেলে অব্যবস্থাপনার কারণে নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম শহরে এমনিতেই বিনোদনকেন্দ্রের অভাব আছে। দীর্ঘদিন ধরে পার্কটি বন্ধ। অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। তাই আমরা পার্কটি পুনরায় বরাদ্দ চেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে লিখেছিও। যদি আমাদের বরাদ্দ দেয় তাহলে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে নগরবাসীর জন্য এটি সুস্থ বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলব।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, পার্ক পরিচালনার দায়িত্ব পালনকালে ২০১৫–২০১৬ অর্থবছরে (২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত) চসিক স্বাধীনতা কমপ্লেক্স থেকে টিকেট বিক্রি করে আয় করে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। যা পূর্বের অর্থবছরে (২০১৪–২০১৫ ) ছিল ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
আবারও বরাদ্দ চেয়েছে চসিক : গত বৃহস্পতিবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীর প্রতীক) এর কাছে স্বাধীনতা কমপ্লেক্স চসিকের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়ার জন্য একটি প্রস্তাব দেন মেয়র ড. শাহাদাত হোসেন। এতে তিনি বলেন, স্বাধীনতা কমপ্লেক্স পূর্বে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে ইজারা দেয়া হয়। তখন চট্টগ্রাম কর্পোরেশন সূচারুভাবে পার্কটি পরিচালনা করে। এতে নগরের শিশু কিশোর ও প্রবীণদের চিত্তবিনোদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এটি।
চসিক–এর ইজারা মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পার্কটি অন্য একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ইজারা দেয়া হলে অতিমুনাফা ও অব্যবস্থাপনার ফলে পার্কটি ক্রমান্বয়ে সাধারণ জনগণের নিকট চিত্ত বিনোদনের জায়গা থেকে হারিয়ে যায় বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।
পার্কটি দীর্ঘদিন যাবত পরিত্যক্ত অবস্থায় বন্ধ রয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, পার্কটি কিশোর গ্যাং, মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যক্রমের কেন্দ্রে পরিণত হয়ে নগরে সামাজিক অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। এ অবস্থায় পার্কটি কর্পোরেশনকে বরাদ্দ প্রদানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সর্বাত্মক আন্তরিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন মেয়র।
জিয়া স্মৃতি পার্ক থেকে স্বাধীনতা কমপ্লেক্স : ৫৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পার্কটি নির্মাণ করে কনকর্ড। ২০০৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এটি উদ্বোধন করেন। তখন এর নাম ছিল ‘জিয়া স্মৃতি কমপ্লেক্স’।
বিএনপির দাবি, দলটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই স্মৃতি ধরে রাখতে বেতার কেন্দ্রের পাশেই এ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। যদিও পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এলে এর নাম পাল্টে করা হয় ‘স্বাধীনতা কমপ্লেক্স’।
জানা গেছে, পার্ক নির্মাণ চুক্তি অনুযায়ী, ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সাল পর্যন্ত পার্কটি পরিচালনা করে কনকর্ড। এরপর ২০১০ সালের জানুয়ারিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমপ্লেক্সটি লিজ নেয় চসিক। ২০১৫ সালের এপ্রিলে চসিকের লিজ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন পার্কটি পরিচালনায় অনাগ্রহ দেখায়। এরপর একই বছরের নভেম্বর মাসে ‘মেসার্স ওয়েল এন্টারপ্রাইজ’ নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইজারা নেয়। এ প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন পরিচালক আ জ ম নাছিরের ঘনিষ্ট বলে পরিচিত।
জানা গেছে, চসিক দায়িত্ব নেয়ার পর পার্কের প্রবেশমূল্য পূর্বের চেয়ে কমানো হয়। যা ‘মেসার্স ওয়েল এন্টারপ্রাইজ’ দায়িত্ব নেয়ার পর আবারও বাড়ানো হয় টিকেটের মূল্য। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, পার্কটিতে রয়েছে পুরো বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর নিদর্শন। জাতীয় সংসদ ভবন, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, সোনা মসজিদ, আহসান মঞ্জিল, কার্জন হল, লালবাগ কেল্লা, শহীদ মিনার, কান্তজির মন্দির, বড় কুঠি, ছোট কুঠি, দরবার হল, সেন্ট নিকোলাস চার্চ, হাইকোর্ট, পাহাড়পুর বিহার, চিরন্তন পল্লীসহ উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলোর আদলে তৈরি করা হয়েছে মিনি স্থাপনা। যেন এক চক্করেই ঘুরে আসা বাংলাদেশের সকল ঐতিহাসিক স্থাপনার আঙিনা থেকে।
এছাড়া পার্কটিতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং বিভিন্ন জেলার ইতিহাস–ঐতিহ্য নির্ভর পাড়ার রেপ্লিকা ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে ২৪তলা বিশিষ্ট ঘূর্ণায়মান হোটেলের সাথে ওয়াচ টাওয়ার ও অ্যামিউজমেন্ট রাউড, প্যাডেল বোট, ফ্যামিলি কোস্টার, বেবি ক্যাসেল, বেলুন হুইল। গতকাল বিকেলে দেখা গেছে, পার্কটির প্রধান ফটকে তালা মারা। পার্কের নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট থেকে এটি বন্ধ। পরবর্তীতে সেখানে কয়েক দফা লুটপাটও হয়েছে। এদিকে গত ১৩ অক্টোবর পার্কটি পরিদর্শন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীর প্রতীক)।