নগরের কাজীর দেউড়ি সার্কিট হাউজ সংলগ্ন শিশু পার্কটি উচ্ছেদের ১৩ মাস পূর্ণ হবে আগামীকাল। উচ্ছেদের পর থেকে শিশুপার্কের জায়গাটি খালি পড়ে আছে। মাঝখানে জেলা প্রশাসন সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রস্তাব করে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এ অবস্থায় শিশু পার্কের জায়গাটিকে সবুজায়নের মাধ্যমে থিমপার্ক করার পরিকল্পনা করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এর অংশ হিসেবে জায়গাটি চসিকের অধীন বরাদ্দ চেয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে আজাদীকে তিনি বলেন, মাঠটি যদি আমরা পাই সেখানে সবুজায়ন করা হবে। সেখানে পরিকল্পিতভাবে একটা থিমপার্ক করে তা সবার সবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে। শহরে সবুজ জায়গা কম। শিশু–কিশোরদের বিনোদনের জায়গাও কম। তাই সেটা নিয়ে পরিকল্পনা করছি।
‘উন্মুক্ত জায়গা বাড়াতে অতীতে পার্ক উচ্ছেদ করা হয়। এখন নতুন করে পার্ক করলে সাধারণ মানুষ আবারও আপত্তি জানানোর সম্ভবনা’র বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, গ্রীন অবয়ব দিয়ে যদি আমরা পার্কটা করতে পারি তখন কারো আপত্তি থাকবে না। তিনি বলেন, শিশু পার্কের পেছনে শহীদ জিয়া স্মৃতি যাদুঘর আছে। পার্কটি উঠিয়ে দিলে পরে যাদুঘরও উঠিয়ে দেয়া যাবে, এমন হীনমানসিকতা থেকে তারা মূলত কাজটি করেছে।
কী আছে চসিকের প্রস্তাবে : গতকাল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সচিব বরাবর দেয়া লিখিত প্রস্তাবনায় বলা হয়, ৬০ বর্গ মাইল বিশিষ্ট চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রায় ৭০ লক্ষাধিক নাগরিকের বসবাস। চট্টগ্রাম শুধু দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও বাণিজ্য নগরীই নয়। পাহাড়, নদী ও সমুদ্রবেষ্টিত এ নগরের অপরূপ সৌন্দর্য পর্যটনের বিরাট সম্ভাবনারও আধার। কিন্তু, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় চট্টগ্রাম শহরে নাগরিকদের জন্য অবসরে সুস্থ বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত উন্মুক্ত পার্ক নেই। এতে বলা হয়, চট্টগ্রাম শহরকে সবুজ–শ্যামল ও বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে সবুজায়ন ও সৌন্দর্য্যবর্ধনের লক্ষ্যে নগরের জিয়া জাদুঘরের সম্মুখে পরিত্যক্ত সম্পত্তিটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন–কে বরাদ্দ প্রদান করা হলে সেখানে সবুজায়নের মাধ্যমে থিমপার্ক তৈরি করে নগরবাসীর জন্য সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করা হবে। যা চট্টগ্রাম শহরকে গ্রীন, ক্লিন, হেলদি সিটি হিসেবে গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
কী বলছেন নগরপরিকল্পনাবিদগণ : বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (বাস্থই) চট্টগ্রাম চ্যাপটারের চেয়ারম্যান আশিক ইমরান আজাদীকে বলেন, যেভাবেই হোক এটাকে সবুজ করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নাই। কারণ, চট্টগ্রামে সবুজ জায়গা একেবারে নেই বললেই চলে। যেগুলো আছে সেগুলোও ধ্বংসের পথে। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে যারা চট্টগ্রামে ছিল বা থাকে তারা জানবে, এই সবুজ জায়গাটা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এখনো যেন মানুষ সেটা ব্যবহার করতে পারে। সবুজ ছাড়া অন্য কিছু হওয়া উচিত না সেখানে। যে গাছপালা আছে সেগুলো রেখে, একটু ওয়াকওয়ে করা যায়। মানুষ যেন সেখানে বসে একটু নিশ্বাস নিতে পাারে। এ বিষয়ে যদি কর্পোরেশন উদ্যোগ নেয় সেটাকে আমরা স্বাগত জানাব।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুক আজাদীকে বলেন, কাজীর দেউড়ি শিশু পার্ক বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই, এটা একটা নগরীর নগরবাসীদের জন্য বেশ দুঃখের ও কষ্টের বিষয়। কারণ, নগরবাসীর মুক্ত বাতাসে ও সবুজের মনোরম পরিবেশে চলাফেরা করা জন্য চট্টগ্রাম মহানগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ৪১টি পার্ক কিংবা খেলার মাঠ দরকার। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর ধারে কাছেও নেই খেলার মাঠ কিংবা পার্ক। যা আছে তাও দিনকে দিন বেদখল হয়ে কংক্রিটের বস্তিতে পরিণত হচ্ছে। আবার চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পূর্বে যে মাস্টারপ্ল্যান হয় সেখানে নগরের বিভিন্ন স্থানে সব বয়েসি (শিশু, কিশোর থেকে বয়স্ক) মানুষের খোলা বাতাসে ও খোলা আকাশের নীচে বিচরণ ও বিনোদনের সুবিধার জন্য ‘কমিউনিটি রিক্রিয়েশনাল এক্টিভিটিজ’ শিরোনামে কিছু জায়গা চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। সেসব জায়গায় পার্ক, বিনোদন স্পট এবং খেলার মাঠ হতে পারত। কিন্তু নগরের কর্তৃপক্ষগুলো মাস্টাপ্ল্যানের এই নির্দেশনা অনুসরণ করেনি।
তিনি বলেন, কাজীর দেউড়ি শিশু পার্ক অতিদ্রুত চালু করা উচিত, সেটা শিশু পার্ক হোক কিংবা সকল বয়সী নাগরিকদের হাঁটাহাঁটি করা কিংবা একটু বিশ্রামের জন্য সবুজে ঘেরা নয়নাভিরাম পার্ক হোক। কারণ, চট্টগ্রাম শহরে সবুজের পরিমান দিনকে দিন কমছে, মনে হচ্ছে কংক্রিটের জঞ্জালের এই নগরীতে সবুজের টিকে থাকা দায়। তাই দ্রুত নগরীর কাজীর দেউড়ি শিশু পার্ক উন্মুক্ত হোক, প্রয়োজনে প্রাকৃতিক সবুজকে প্রাধান্য দিয়ে আরো সৌন্দর্যমন্ডিত করে।
জায়গা চসিকের তত্ত্বাবধানেই ছিল : জায়গাটির (শিশু পার্ক যেখানে গড়ে উঠে) আয়তন তিন একর। এর মূল মালিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৯৯২ সালের ১৩ জুলাই এটি চসিককে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ বছরের জন্য ইজারা দেয় চসিক। তারা সেখানে শিশু পার্ক করে। ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ১৫ বছরের জন্য ঢাকার ওই একই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১৫ বছরের চুক্তি নবায়ন করে চসিক। মাঝখানে ২০০৮ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিজেদের জমি ফেরত চান। সর্বশেষ চুক্তির শর্ত ভঙ করায় চসিককে জায়গাটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান করে যে অনুমোদন দেয়া হয় তা ২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর বাতিল করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
এরপর একই বছরের ২৩ অক্টোবর পার্কটি সীলগালা করে জমির মালিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন। অবশ্য এর আগে চসিকের অনুকূলে পার্কটির জায়গার বরাদ্দ বা লিজ বাতিল চেয়ে একই বছরের ২৩ আগস্ট প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, ২৭ আগস্ট সামরিক ভূমি ও ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইস্টার্ন সার্কেলের সামরিক ভূুসম্পত্তি প্রশাসক বরাবর পৃথক তিনটি দাপ্তরিক পত্র দেন চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। একইবছরের ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইস্টার্ন সার্কেলের সামরিক ভূ সম্পত্তি প্রশাসক বরাবর দেয়া আরেকটি পত্রে জায়গাটি জেলা প্রশাসনের অনুকূলে বরাদ্দ চাওয়া হয়। এতে জায়গাটিতে উন্মুক্ত স্থানসহ মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার প্রস্তাব করা হয়। উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময়ে পার্কটি উচ্ছেদের দাবি ওঠে।