(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ঘুরছিলাম আমরা। হাজার হাজার মানুষের সাথে পা মিলিয়ে পথ চলছিলাম। চীনের সুঝৌ শহরের এনসাইয়েন্ট সিটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিস্ময় দেখছিলাম ঘুরে ঘুরে। কাঠশিল্পের দোকান থেকে বের হয়ে আমরা আরো কয়েকটি দোকানে চক্কর মারলাম। চীনা বুদ্ধির জয়জয়কার সর্বত্রই। কী অসাধারণ সব পণ্য। কী দারুণভাবেই না তৈরি করা হয়েছে। দামও প্রচুর। আমরা ওসব দামি পণ্যের ধারে কাছে গেলেও কিনলাম না, টুকটাক কয়েকটি স্যুভেনির কিনে নিলাম। কিন্তু দেখে যেনো মন ভরছিল না। কী চোখ ধাঁধানো সব আয়োজন চারদিকে! ছোট্ট একটি এলাকাকে কী নান্দনিকভাবেই না ‘টিকিয়ে’ রাখা হয়েছে। একেবারে ‘অটুট’ রাখা হয়েছে সবকিছু। আসলে অটুট বলতে কিছু না করেও যে কিভাবে একটি এলাকাকে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে রাখা যায় তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
একটি খাল, কয়েক হাজার বাড়ি এবং দোকানপাটকে ঘিরে টিকিয়ে রাখা এনসাইয়েন্ট সিটি বা পুরানো শহরটির পরতে পরতে রয়েছে ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্যের খোঁজে হাজার হাজার পর্যটক সকাল থেকে রাত অব্দি হুমড়ি খেয়ে পড়েন। আমার কাছে নিজের ঐতিহ্য না হলেও আড়াই হাজার বছর আগেকার চীনারা কিভাবে জীবনযাপন করতেন তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে মন্দ লাগছিল না। নিশ্চয় আমাদের পূর্ব পুরুষেরাও এমনতর অনাড়ম্বর আয়োজনে জীবন পার করে দিয়েছেন। যাদের রেখে যাওয়া সম্পদের উপর আমাদের আজকের এই আধুনিক জীবনযাত্রা। অথচ আমরা কয়জনই বা তিন চার পুরুষ আগেকার স্বজনদের নাম জানি, মনে রাখি! আজ থেকে তিন পুরুষ পরে আমার নামই বা কে মনে রাখবে, আমার স্বজনদের অন্তরে কি আমার জন্য একটু জায়গা থাকবে! কেউ কী মনে রাখবে আমাকে!
বাঁকানো একটি সেতুর রেলিংয়ে বসে উদাস হয়ে নানা ভাবনা ভাবছিলাম। লায়ন ফজলে করিম এবং ডালিয়া ভাবীও বসে রয়েছেন। আমাদের গাইড এবং প্রটোকলের দুই লেডি অফিসার ফ্রাঞ্চি এবং শাসা কলম্বিয়ান দম্পতিকে নিয়ে কোনদিকে যেনো ঘুরছে। কলম্বিয়ান দম্পতি বেশ কেনাকাটাও করছেন। কি করে এসব ওই দূরদেশে নিয়ে যাবেন কে জানে!
আরো অনেকক্ষন বসে বসে গল্প করলাম আমরা। শাসা বললো, এবার ফিরতে হবে। চীনা ভাষায় লায়ন ফজলে করিম ভাইকে সে যা বললো তার অর্থ হলো, হয় আমাদেরকে ফিরতি পথে হেঁটে যেখানে বাস থেকে নেমেছিলাম সেখানে গিয়ে বাসে চড়তে হবে, অন্যথায় ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি এদিকে আনাতে হবে। আপনারা কি যাবার পথে আরো কিছু দেখে তারপর বাসে চড়বেন, নাকি এখানে একটু সামনে গিয়ে চড়বেন। বুঝতে পারলাম যে, এনসাইয়েন্ট সিটির দুইদিকেই আধুনিক রাস্তা বয়ে গেছে। মাঝের জায়গাটিই শুধু পুরানো শহর হিসেবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
লায়ন ফজলে করিম ভাই আমার চোখে চোখ রাখলেন। অর্থাৎ আমি কি চাই! এখান থেকে বাসে চড়বো, নাকি আবারো ভিড়ভাট্টা ঠেলবো! মানুষ দেখতে ভালো লাগছিল আমার। ভীড়ের মধ্যে হাঁটতেও খারাপ লাগছিল না। নানা রঙের নানা বর্ণের নানা সাজের মানুষ দেখে সময়টা দারুণ কেটে যাচ্ছিল। করিম ভাইকে ফিরতি পথে হেঁটে যাওয়ার আগ্রহ দেখালাম। তিনি ফ্রাঞ্চি এবং শাসাকে ফিরতি পথে হেঁটে যাওয়ার কথা বললেন। নায়িকার মতো সুন্দরী কলম্বিয়ান তরুণী বধূ বেশ আগ্রহ নিয়ে হাঁটছিলেন। আমরা আবারো দলবেঁধে মানুষ দেখতে দেখতে ফিরতি পথ ধরে এগুতে লাগলাম। পথের ধার দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটিতে পর্যটকবাহী নৌকা ঘুরছে, একা একা নৌকায় ঘুরছেন শহরের পরিচ্ছন্নতা কর্মী। তারা খালে একটি গাছের পাতা ঝরলেও সেটি চাকনি দিয়ে তুলে নিচ্ছে।
ছুটছিল আমাদের বাস। বিশাল বাসটিতে আমরা মাত্র কয়েকজন মানুষ হেথায় হোথায় বসে আছি। প্রচুর ফলমূলসহ শুকনো খাবার রয়েছে গাড়িতে। আমরা যে যার মতো করে কমলার খোসা ছড়ানোর পাশাপাশি বিস্কিটের প্যাকেটও ছিড়ছিলাম। পানির বোতলে হাত না দিয়ে জুসের বোতলে চুমুক দিচ্ছিলাম।
আবারো সেই আলীশান রাস্তা, সেই চোখজুড়ানো সবুজ, বর্ণিল ফুল। ছুটছিল আমাদের বাস। নখের পিঠের মতো রাস্তায় গাড়িতে চড়ে বিমানের চেয়ে বেশি আনন্দ পাওয়া যায়। যা আমরা সকলেই পাচ্ছিলাম। গাড়িতে চড়ছি বলে মনে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল বিছানায় বসে আছি। আমরা একেকজন দুই সিট করে নিয়ে বসার ফলে পা তুলে ইচ্ছেমতো হেলান দেয়ার সুযোগ পেয়েছি। একটি চাবি ঘুরিয়ে বাসের সিট পেছনে ঠেলে দিয়ে অনেকটা বিছানার মতো করে নিলাম। হাত পা ছড়িয়ে এক আলীশান যাত্রায় পথ চলছিলাম আমরা। ছয় লেনের রাস্তার বাইরে কোথাও জনপদ, ছোট বড় ভবন, কোথাও বা সুউচ্চ সব ভবন আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা করছে। কোথাও ফসলের ধূ ধূ মাঠ, আবার কোথাও আপেল কমলাসহ নানা ফলের বাগান। পুরো মাঠ জুড়ে থাকা ফুলের বাগানও দেখা গেলো। কী যে সুন্দর! কী অপরূপ রূপ!
কিন্তু বেশিক্ষণ লাগলো না। আমাদের বাস বড় রাস্তা থেকে নেমে মোড় নিয়ে ছোট্ট একটি রাস্তা ধরে এগুতে লাগলো। কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। এতো সুন্দর রাস্তা ছেড়ে আবার গলিতে ক্যান! আমাদের গাড়ি চলছিল। মনে হচ্ছিলো বন–বনানীর ভিতর দিয়ে চলছি আমরা। চারদিকে এতো গাছ! শতবর্ষী গাছ তো প্রায়শঃ দেখা যায়, কিন্তু এখানে মনে হচ্ছিলো আরো বেশ বয়সী অনেক গাছ। ছোট্ট একটি পাহাড়ের মতোও দেখা গেলো। কিন্তু এই পাহাড় বনের ভিতরে আসলে আমরা যাচ্ছি কোথায়। কৌতূহল কিংবা ভয় ছাপিয়ে রাখতে না পেরে ফ্রাঞ্চির সিটের কাছে গেলাম। কোথায় যাচ্ছি আমরা? চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলাম। আমার প্রশ্নের ধরণ দেখে ফ্রাঞ্চি হেসে উঠলো। বললো, হোটেলে। এখানে আজ রাত কাটাবো আমরা। কাল অন্য প্রোগ্রাম।
কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। ফ্রাঞ্চি নিশ্চয় করিম ভাইকে বিপদে ফেলবে না। সাথে ডালিয়া ভাবীও রয়েছে। গাছগাছালীর ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তা ধরে কিছু পথ পাড়ি দেয়ার পর আমাদের বাস থামলো একটি কটেজের সামনে। চারদিকে বন, বনের ভিতরে একতলা সব ঘর। কী যে সুন্দর চারদিকে!
বনবাসে এতো আয়োজন থাকে না। তবে বনের ভিতরে এমন বসবাসের আয়োজনে আমি শিহরিত হলাম। বাস থেকে আমাদের লাগেজ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা যে যার ব্যাগ টেনে নিয়ে একতলা একটি ঘরে ঢুকলাম। এটি কটেজের রিসিপশন। ডেস্কে বসা দুই তরুণী। আমাদের পাসপোর্ট চেয়ে নিলো তারা। অপর এক তরুণী ওয়েলকাম ড্রিংকসের ট্রে নিয়ে হাজির হলো সামনে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আমি চারপাশ দেখছিলাম। আয়োজনে আধুনিকতা রয়েছে, স্থাপত্যে রয়েছে আধুনিকতার নান্দনিক ছোঁয়া। কিন্তু কটেজগুলোর প্রতিটি এক তলা এবং একটি ঘর থেকে অপরটি বেশ দূরে দূরে। মাঝের খালি জায়গাগুলো গাছগাছালিতে ভরা, ছোট বড় নানা ধরনের গাছ। গাছগুলোর নিচে দোলনা এবং বসার নানা আয়োজনও রয়েছে। রয়েছে ওয়াকওয়ে। রুমের ভিতরে ভালো না লাগলে বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে থাকুন, হাঁটতে ইচ্ছে না করলে দোল খান, বসে বসে প্রকৃতি দেখুন। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।