ভূমণ্ডলের যে অংশে কোনো জাতি গোষ্ঠী সম্প্রদায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট একটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে সামাজিক রাজনৈতিক এবং সর্বোপরি বলপ্রয়োগকারির মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে তাকে রাষ্ট্র বলা হয়। রাষ্ট্র হল মানবজাতির সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন। সরকার হলো একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম উপাদান। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয় বিধি নিষেধ আরোপিত এবং সকল কার্য সম্পন্ন হয়। সুসংগঠিত সরকারের অভাবে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বিরাজ করে। রাষ্ট্র এবং সরকার অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাষ্ট্র গঠিত হয় জনসমষ্টি, ভৃখণ্ড, সরকার এবং সার্বভৌমত্বের সমন্বয়ে। রাষ্ট্র হল সামগ্রিক আর সরকার হল সেই সামগ্রিকের অংশ মাত্র। রাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত একটি প্রতিষ্ঠান, সরকার হল তার মুখপাত্র। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হয়। দৃশ্যমান তিনটি বিভাগ কর্তৃক সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ। সুষ্ঠু সুশৃঙ্খল ভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে রাষ্ট্র একটি সংবিধান প্রণয়ন ও তা অনুসরণ করে কোনো অবস্থায় সরকারের পক্ষে সংবিধান লংঘন করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর সর্বত্র রাষ্ট্রের প্রকৃতি বৈশিষ্ট্য এক ও অভিন্ন । কিন্তু সরকারের রূপ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হতে পারে। কোনো দেশে গণতন্ত্র, কোনো দেশে সমাজতন্ত্র, কোথাও সামরিকতন্ত্র কোথাও রাজতন্ত্র আবার কোথাও স্বৈরতন্ত্র। গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধান মন্ত্রী বা মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার কোথাও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসিত সরকার ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ যৌক্তিক কারণে অনাস্থা জ্ঞাপন করতে পারে এরূপ অবস্থায় সরকার ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য থাকে। রাষ্ট্র হল স্থায়ী ও চিরন্তন, কিন্তু সরকার পরিবর্তনশীল। সরকার আসে যায় বিলুপ্ত হয় পূর্ণগঠিত হয়, কিন্তু রাষ্ট্রের বিলোপ ঘটে না। রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমাহীন ও চরম কিন্তু সরকারের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্র সকল অধিকারের উৎস রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কারো কোনো অধিকার নেই কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে সকলের অধিকার রয়েছে। বিভিন্ন আন্দোলন ও হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অধিকার আদায় করা যায়। সরকার হল একটি সংগঠন যা পরিবর্তনশীল আর রাষ্ট্র হল অপরিবতনীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক মৌলিক প্রতিষ্ঠান। একটি রাষ্ট্রে প্রকৃত সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চা ও সফল সার্থকতার পূর্ব শর্ত হচ্ছে জনগণের শিক্ষা। উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষার মান, শিক্ষিতের হার শিক্ষা ক্ষেত্র নানা সমস্যায় জর্জরিত। শিক্ষায় অনগ্রসরতা উন্নয়নশীল দেশসমূহে সুষ্ঠু গণতন্ত্র বিকাশের প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশ এমন পর্যায়ের একটি রাষ্ট্র যা কাগজে কলমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হলেও এ দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সুদূর পরাহত। গণতন্ত্র হল জনগণের শাসন। এ শাসন ব্যবস্থায় জনগণের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, বহু দলীয় ব্যবস্থা, সহনশীলতা, জনমতের প্রাধান্য, নাগরিকদের অধিকারের স্বীকৃতি, সাম্য দায়িত্ব শীতলতা প্রভৃতি বিদ্যমান থাকবে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হলেও প্রকৃত গণতন্ত্রের বহুবিধ বৈশিষ্ট্যবলি বাস্তবায়নে ব্যর্থ। খণ্ডিত বিছিন্ন জোড়াতালির সংমিশ্রণে গণতন্ত্রের রূপ দিতে গিয়ে এ দেশের শাসন ব্যবস্থা জনগণের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণে প্রতিটি সরকার প্রহসনের আশ্রয় নিয়েছে। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্র দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এ দেশে টেকসই স্থায়ী রূপ ধারণ ও বাস্তবায়ন না হওয়ার এক মাত্র কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চার অভাব। সরকার ব্যবস্থা যে রকমই হোক প্রত্যেক সরকারের কাছে জনগণের চাওয়া পাওয়া ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশা অনেক কিছুই থাকে। একটি সরকার দেশ জাতি ও জনগণের সামষ্ঠিক প্রভূত কল্যাণ নিশ্চিত করবে সুশাসনের মাধ্যমে। গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্যবলি বাস্তবায়ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। অন্য সব সরকার ব্যবস্থায় জনগণের মৌলিক স্বাধীনতা খর্ব করা হয় এবং জনঅধিকার ভোগ করার সুযোগ থাকে অবরুদ্ধ। স্বাধীনতার পর এ দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠন খুব একটা হয়েছে এমন বলা যাবে না। তবু মন্দের ভালো যে সরকারগুলো ক্ষমতাসীন হয়েছে তাদের মধ্যেও বিরাজ করেছে গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতার মসনদ দীর্ঘায়িত করার নানা ষড়যন্ত্র। রাজনৈতিক নানা ঘাত প্রতিঘাতের উত্থান পতনের ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন এদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শুভ সূচনার ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। এ নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতাসীন হয়েছিল দুর্বল নেতৃত্ব ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার অভাবে জাতিকে সঠিক গণতান্ত্রিক ভাবধারায় আদর্শে উজ্জীবিত অনুপ্রাণীত অবিচল জাতিতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছ। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা বা পদ্ধতি সর্বজন গ্রাহ্য স্থায়ী রূপ এখনও অনির্ধারিত যা সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অন্যতম অন্তরায়। এখন ও প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে শুরু হয় নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে নানা দ্বন্দ্ব যা আন্দোলন ও সংঘাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সংবিধান সংশোধন ও আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সরকারের অধীন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা বিধান পাশ করে। যদিও এ আইন পাশ করার বিরুদ্ধে বি এন পি সহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের আপত্তি ছিল কিন্তু আওয়ামীলীগের একগুঁয়েমির কাছে তা কার্যকর হয়নি। এ আইন পাশ করার পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের অধীন যে নির্বাচন করেছে দেশ–বিদেশে প্রচুর সমালোচনা ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রের জাল বুনতে থাকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র যন্ত্রের সব কিছু আওয়ামীময় করার চেষ্টা সফল হয় এবং এতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র পরিচালনার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কোনো সরকার যখন গণতন্ত্রের বিকল্প পথে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় তখন সে প্রতিটি ক্ষেত্রে অতি মাত্রায় বেপরোয়া হয়ে পড়ে। সে সরকারের কাছে দেশ ও জাতির আর কোনো কিছুই নিরাপদ থাকে না। ক্ষমতার মসনদ নিরাপদ ও অটল রাখতে প্রশাসনের সকল স্তরে কর্মকর্তা কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দেয় যার ফলে আমলাতন্ত্রে সততা দক্ষতা নিরপেক্ষতা নীতি নৈতিকতা আর্দশ পরিকল্পনা মত কাজ না করে দলীয় প্রভাবে কাজ করে। এতে নিরপেক্ষ ও গতিশীল প্রশাসন ব্যবস্থার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে যার ফলে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়ে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। দলীয় নেতা কর্মী থেকে সকল পর্যায়ে দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করে। শাসক শ্রেণি দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে বিদেশে পাচার করে এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায় ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় জনগণ উন্নয়নের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। দেশে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য অর্থনৈতিক অসাম্য, আইনের শাসনের অভাব, জাতীয় ঐক্যের অভাব, সহনশীলতার অভাব, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, পরিবারভিত্তিক রাজনীতি, দুর্নীতি, রাজনৈতিক মেরুকরণ, নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব বিস্তার ঘটে। প্রবন্ধে আওয়ামীলীগের প্রসঙ্গটা টেনে আনার কারণ ২০০৮ সালে সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে সুশাসনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রকে সুসংহত ও প্রতিষ্ঠিত করে জনগণের আস্থা অর্জনের বিরাট সুযোগ ছিল কিন্তু আওয়ামীলীগ সে সুযোগ কাজে না লাগিয়ে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারী পথে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে গিয়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আওয়ামীলীগের এমন বিপর্যয় থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষা নেয়া উচিত। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করলে বিশ্বের যে সব রাষ্ট্রকে আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে দেখা হয় সেখানে ও জনগণ পরিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করছে না। জনগণ বা শ্রমিক সংগঠনগুলোর ন্যায্য দাবি দাওয়া শাসক গোষ্ঠী চাপ বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে কঠোর হস্তে বানচাল করে দেয়। আবার কোনো কোনো রাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে মোটামুটি স্বাধীন ও প্রভাব মুক্ত আদালত রয়েছে সে সব রাষ্ট্রেও সুষ্ঠু স্বাধীন নির্বাচনে ভীতি প্রদর্শন, উৎকোচ প্রদান, ভোট কারচুপি কালো টাকার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। রাষ্ট্রের সাথে গণতন্ত্রের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ। আদি কাল থেকে বিশ্বে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্র বিভিন্ন সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অত্যন্ত জনপ্রিয় সর্বোৎকৃষ্ট কল্যাণধর্মী কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জনমতের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালিত হয় বলে এ ব্যবস্থায় দেশ ও জাতির সর্বাধিক কল্যাণ নিহিত থাকে।
লেখক: প্রাবন্ধিক।