আজাদীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাসা থেকে বের হয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন। অজান্তেই ঝুঁকিতে পড়েছে আপনার স্বাস্থ্য। ভাবছেন, কীভাবে সম্ভব? এ ঝুঁকি দুইভাবে হচ্ছে। প্রথমত রাস্তায় চলা অসংখ্য গাড়ির মাত্রাতিরিক্ত হর্ন সৃষ্টি করছে শব্দ দূষণ, যার প্রভাব পড়ছে শরীরে। এ দূষণের কারণে হৃদরোগের ঝুঁকির পাশাপাশি স্থায়ীভাবে শ্রবণ শক্তি হারানোরও আশঙ্কা আছে। দ্বিতীয়ত গাড়ির কালো ধোঁয়া ও কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং ধুলোবালিসহ অন্যান্য কারণে সৃষ্ট বায়ু দূষণ। এটাও শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তবে কি শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে কোনো সবুজ উদ্যান বা পাহাড়ে ছুটে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন? যেখানে গাড়ির হর্নের বদলে আছে পাখির কিচিরমিচির! কিংবা আছে সবুজ গাছপালায় মন ভরে শ্বাস নেয়ার আয়োজন। সে আশাও পূরণ হবে না। কারণ শহরে পাহাড়ের সংখ্যা দিন দিন কমছে। যে কয়টি অক্ষত আছে সেখানেও বনায়ন নেই। আছে অবৈধ বসতি। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্য অনুযায়ী, ৪০ বছর আগেও নগরে ২০০ পাহাড় ছিল, যার ৬০ শতাংশ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। এছাড়া নগরে কোনো উদ্যান নেই, যেখানে একজন নাগরিক শ্বাস নেবেন প্রাণভরে।
গত ১৬ নভেম্বর ‘পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকুক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আজাদীতে। এতে বলা হয়েছে, সরকারি অর্থে নির্মিত নগরের জাতিসংঘ পার্কে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত চায় পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির চাওয়া কেবল পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার বাসিন্দারাই পার্কটি ব্যবহার করুক। বাইরের কেউ যেন ব্যবহার করতে না পারে। এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করা হয়েছে সংগঠনটির পক্ষে। তবে সাধারণ মানুষ এবং নগর পরিকল্পনাবিদরা এর বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা বলছেন, ‘পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকুক। জনগণের ট্যাঙের টাকায় নির্মিত পার্ক সাধারণ মানুষের ব্যবহারের অধিকার আছে। এতে বাধা দেয়া ঠিক হবে না।’ তবে আবাসিক এলাকা বিবেচনা করে সেখানে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।
জানা গেছে, নগরের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় অবস্থিত জাতিসংঘ পার্কটি ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকায় নতুন করে নির্মাণ করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলেও পার্কটি এখনো উন্মুক্ত করা হয়নি। উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে পার্কটি। উদ্বোধনের অনুমতি চেয়ে এক মাস আগে চট্টগ্রাম গণপূর্ত অধিদপ্তর মন্ত্রণালয়ে চিঠিও লিখে। মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পেলে উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ করা হবে। ওই হিসেবে যে কোনো মুহূর্তে পার্কটি উদ্বোধন করা হতে পারে। এদিকে উদ্বোধন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পত্র দিয়ে পার্কটির ব্যবহার সংরক্ষিত রাখার আবেদন করে। একইসঙ্গে পার্কটি ঘিরে বাণিজ্যিকীকরণেরও আপত্তি জানায়। পার্কে একটি দোকান নির্মাণ করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর; যেটি বরাদ্দ দিলে চালু হবে। এ দোকান নিয়েই আপত্তি পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির। অবশ্য নগরপরিকল্পনাবিদরাও দোকান বরাদ্দের বিপক্ষে।
জীবন ও জীবিকা এক সরলরেখায় চলে। সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিতে অসীম নিয়ামত দিয়ে রেখেছেন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য। অক্সিজেন কারখানা সৃষ্টির ক্ষমতা দিয়েছেন গাছপালাকে। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ গাছপালা কেটে রাস্তা ঘাট, দোকানপাট, চাষাবাদ, ঘরবাড়ি, নগরায়ন, আধুনিকীকরণ করছে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সুস্থ ভাবে, সবল ভাবে বেঁচে থাকতে হলে চিত্তের সুস্থতা আগে প্রয়োজন সুস্থ দেহ সুস্থ মন। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক আগে থেকেই হারাতে বসেছে পাহাড় আর গাছ পালা নিধনের মাধ্যমে। সেই জায়গায় জাতিসংঘ পার্কটি ঘিরে বাণিজ্যিকীকরণেরও চিন্তা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেন, নগর পরিবেশ ও নাগরিক সুযোগ–সুবিধার প্রতি যত্নবান হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের সবার গন্তব্য এখন নগর। আমরা সবাই চাই নগরে বসবাস করতে। নগরের আধুনিক নান্দনিকতার জন্যই হোক অথবা গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানের অভাবেই হোক– সবাই ধরে নিয়েছে নগরই একমাত্র কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। এ জন্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে নগরের জনসংখ্যা, বাড়ছে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা। ২০০৮ সাল থেকে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নগরে বসবাস করে। এই হারে বাড়তে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ নগর জনসংখ্যার পরিমাণ হয়তো ৭০ শতাংশে পৌঁছবে। নগরে আগুয়ান সমস্যাগুলো উন্নত বিশ্বের চেয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বেই প্রসার ঘটবে বেশি।
এ অবস্থায় কেবল আবাসিক এলাকার লোকজনের জন্য পার্কের সুযোগ সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবে না, জাতিসংঘ পার্ককে উন্মুক্ত রাখা জনদাবিতে পরিণত হয়েছে।