দ্রুত নির্বাচন চেয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এ সময় তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারই কেবল আগামী দিনে বাংলাদেশ কোথায় যাবে, এখানে কি কি সংস্কার করতে হবে এবং দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারবে বলে দাবি করেন। বিএনপিকে থামানোর চেষ্টা না করার হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, বিএনপিকে যারা থামাতে গেছে তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের সরকার ও সংসদ দেখতে চায়। এটাকে বাধাগ্রস্ত করার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপি এজন্য বিগত দিনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। প্রয়োজনে আবারও ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা রাজি আছি।
গতকাল শনিবার বিকালে নগরের ষোলশহর বিপ্লব উদ্যানে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় যুবদলের দিনব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে আয়োজিত সমাবেশ ও বিপ্লব উদ্যান থেকে কালুরঘাট অভিমুখী যুব পদযাত্রায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্নার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নয়নের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন, কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ–সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ও মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান। সমাবেশ শেষে যুবদলের কয়েক হাজার নেতাকর্মী বিপ্লব উদ্যান থেকে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র পর্যন্ত পদযাত্রা করেন। এতে বিএনপিসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন।
আমীর খসরু বলেন, গণতন্ত্র কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কেউ বলে দিতে পারবে না আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনীতি কী হবে। সেটা একমাত্র বাংলাদেশের জনগণ বলবে। আর কারও বলার কোনো সুযোগ নেই। এ রকম বলার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেকে চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব চেষ্টা করেছেন, পারেননি। এরশাদ এসে তার মতো ন্যারেটিভ তৈরি করেছিলেন, পারেননি। শেখ হাসিনাও এসে নিজস্ব ন্যারেটিভ তৈরি করেছিলেন, পারেননি। আমরা সবাইকে বলব, বাংলাদেশের জনগণকেই তাদের ন্যারেটিভ তৈরি করতে দেন, তাদের সিদ্ধান্ত তাদের নিতে দেন।
তিনি বলেন, বিএনপিকে ভাঙার জন্য, ধ্বংস করার জন্য হেন কিছু নেই যা করা হয়নি। কিছুই বাকি ছিল না। বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছে। ১৫ বছরে তো আমাদের নেতাকর্মীরা বাড়িঘরে থাকতে পারেনি। চাকরি ও ব্যবসা হারিয়েছে। পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীরা জীবন ও রক্ত দিয়েছে, গুম ও খুন হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীরা বছরের পর বছর মিথ্যা মামলায় জেলখানায় কাটিয়েছে, আমিও কাটিয়েছি। এসবের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিএনপিকে ধ্বংস করে দেওয়া। কিন্তু আজ বিএনপি কোথায় আর যারা বিএনপিকে ধ্বংস করতে গিয়েছিল, তারা কোথায়? আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি, অনেক কিছু হারিয়েছি, জীবনের ভালো সময় হারিয়েছি, অনেক নেতাকর্মীকে আমরা হারিয়েছি। কিন্তু একটা ভালো কাজ হয়েছে, বিএনপির নেতাকর্মীরা জ্বলে–পুড়ে খাঁটি সোনায় তৈরি হয়ে গেছে। এজন্য বিএনপিকে ভাঙতে পারেনি।
খসরু বলেন, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছি। সবাই মিলে দেশ গড়ি। তারেক রহমান নিজেই জাতীয় সরকারের ঘোষণা দিয়েছেন। উনি বলেছেন, বিএনপি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও থাকে, তারপরও জাতীয় সরকার করব। কেন করব? বাংলাদেশের মানুষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। আমরা কোনো বিভক্তি চাচ্ছি না। সেই জায়গা থেকে বিএনপি সরে যাবে না। বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব জাতীয় নির্বাচনের সময় জনগণের সামনে উপস্থাপন করবে। পরবর্তী সময়ে জাতীয় সরকারের মাধ্যমে, সবাইকে নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেটা বাস্তবায়ন করবে।
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানসহ অনেকে সম্মুখযুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। অনেকের অনেক ভূমিকা আছে। সবাইকে স্বীকৃতি দিতে হবে। জিয়াউর রহমানের অবদান অন্যতম। আরও অনেকের অবদান আছে। এজন্য ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বলে একটা কথা আছে, জাতির জনক বলতে যা বোঝায়, এটা তো কোনো এক ব্যক্তির কথা নয়, এগুলোর পেছনে অনেক নেতার ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অনেক নেতাকে জীবনযুদ্ধে নামতে হয়েছিল। এজন্য সবাইকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
তিনি বলেন, এজন্য আমেরিকাতে এদেরকে বলে ফাউন্ডিং ফাদার্স। অর্থাৎ যার যার অবদান আছে সকলকে স্বীকৃতি দিয়ে জাতির জনক হিসেবে, একাধিক ব্যক্তি যাদের অবদান আছে তাদের স্বীকৃতি দিয়ে সবাইকে ওরা স্মরণ করে। কোনো একজন ব্যক্তি নয়।
খসরু বলেন, একজন ব্যক্তিকে সিম্বল হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশে যে খুন, গুম, হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, লুটপাট, বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার, আইনের শাসন কেড়ে নেওয়া, বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করা, একটি মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করা, সেই ব্যক্তির নাম দিয়ে, সেই ব্যক্তির মূর্তি স্থাপন করে সারা বাংলাদেশে তারা এ খারাপ কাজগুলো করেছে। সেই স্বৈরাচারের যখন পতন হয়, যে ব্যক্তিকে ব্যবহার করে এ খারাপ কাজগুলো তারা করেছে, সেই ব্যক্তির মূর্তিগুলোও সব নেমে যায়। যে ব্যক্তিকে ব্যবহার করে এই খারাপ কাজগুলো করেছে, তাদের সাথে সাথে হঠাৎ করে সেই ব্যক্তিও যেন জনগণের কাছ থেকে চলে যায়।
তিনি বলেন, একটা সিম্বল ব্যবহার করে খারাপের পর খারাপ কাজ করতে থাকেন, এরপর আপনার যখন পতন হয়, তখন ওই সিম্বলেরও পতন হয়। এটা দুর্ভাগ্য। আমরা যদি সকলকে স্বীকৃতি দিতাম, আমরা যদি গণতন্ত্র অব্যাহত রাখতাম, আমরা যদি দেশের মানুষের অধিকারগুলো দিতাম, ভোটাধিকার দিতাম, তাদের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার যদি ক্ষমতায় থাকত, যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকত, চরম দুর্নীতি, অর্থপাচার, এগুলো থেকে দেশটা বেঁচে যেত। সুতরাং স্বাধীনতাকে মূলধন করে, কোনো ব্যক্তিকে মূলধন করে কোনো খারাপ কাজ টিকে থাকতে পারে না। এটা বাংলাদেশে প্রমাণ হয়েছে।
আমীর খসরু জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন অবদানের কথা তুলে ধরে বলেন, ঐক্যের টান হচ্ছে জিয়াউর রহমান পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রিভোল্ড করেছিলেন। পাকিস্তানিদের মুখের ওপর বলেছিলেন, আমি তোমাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘোষণা করেছি। সেই ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানিদের তৎকালীন অফিসারদের অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। সেই বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। সেখান থেকে এ ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশি সৈন্যদের নিয়ে তিনি বের হয়েছিলেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। এরপর কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গিয়ে প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে জিয়াউর রহমান বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম। কিন্তু তিনি প্রথম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেননি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলেছেন। স্বাধীনতার এ কথাগুলো অনেকে বলতে সাহস পায় না, লজ্জা পায়।
খসরু বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান তো পাকিস্তানে চলে গেছেন। বাংলাদেশের মানুষ পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। এ সময় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষকে পথ নির্দেশনা পরিষ্কারভাবে জিয়াউর রহমান দিয়েছেন। এরপর পুরো জাতি যুদ্ধে নেমে গেছে।
মোনায়েম মুন্না বলেন, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। ১৯৭১ সালে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় যখন দেশ অন্ধকারের মধ্যে, তখন মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ইতিহাস নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু জনগণের হৃদয় থেকে মুছতে পারেনি। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাননি, রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন।
নুরুল ইসলাম নয়ন বলেন, দীর্ঘ ১৮ বছর পর আমরা ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি। এ মুক্ত স্বাধীন দেশে আমরা ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক এ দিনকে ঘিরে কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। কারণ তরুণ প্রজন্মের কাছে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিটি সেক্টরে জিয়াউর রহমানের অবদান রয়েছে।
সমাবেশে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এস এম সাইফুল আলম, শফিকুর রহমান স্বপন, মো. শাহ আলম, সদস্য আবুল হাসেম, নগর যুবদলের সাবেক সভাপতি মোশাররফ হোসেন দীপ্তি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহেদ, যুবদল নেতা মাহফুজুর রহমান, রেজাউল করিম লিটন, ফেরদৌস আহমেদ মুন্না, মনজুরুল আজিম সুমন, জাহিদ হাসান, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মিনহাজুল ইসলাম ভূঁইয়া, কামাল উদ্দিন, সাইফুর রহমান শপথ, আমিনুল ইসলাম তৌহিদ, সোহেল, হুমায়ুন কবির, মো. শাহজাহান, মো. আজগর হাসান জসিম, এস এ মুরাদ চৌধুরী ও নগর যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এমদাদুল হক বাদশা।
চিত্র প্রদর্শনী : সমাবেশের আগে বিপ্লব উদ্যানে রং তুলিতে আঁকা স্বাধীনতার ঘোষণা চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম ও সহ–সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। সকালে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অতিথি ছিলেন নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ। এর আগে ভোরে রাঙ্গুনিয়ায় জিয়ানগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের প্রথম সমাধিস্থলে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় যুবদলের দিনব্যাপী কর্মসূচি শুরু হয়।