একটা সমগ্র জীবনে ছেলেদেরকে কতগুলো ইচ্ছার সাথে কমেপ্রামাইজ করতে হয়? খুব সামান্যই। আর মেয়েদের ইচ্ছার কমেপ্রামাইজের সংখ্যা? প্রায় সবগুলোই। মেয়েটা যতদিন বাবার গৃহে থাকে, বাবার আদরে, মায়ের স্নেহে থাকে তখন অনেক চাওয়া সে বলতে পারে–ইচ্ছা পূরণ হয়। কিন্তু মেয়েটা যখন ভিন্ন পরিবেশে যায়, কারো ইচ্ছার শেকলে বন্দি হয় তখন তাকে পরিবেশের সাথে মানাতে হয়। স্বামীর ইচ্ছা শুনতে হয়। শ্বশুর–শাশুড়ির মন যুগিয়ে চলতে হয়। পরিবারের–আত্মীয় স্বজনের পছন্দ–অপছন্দও তাকে মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয়। যেদিন থেকে মেয়েটা মা সেদিন থেকে তার নিজস্বতা বলতে আর কিছু থাকে না। সন্তানকে ঘিরে স্বপ্ন, সন্তানকে ঘিরেই বাঁচা। সমাজ–সংসার মেয়েদের জন্য, মায়েদের জন্য মোটামুটি একটা শক্ত মানের খাঁচা তৈরি করেছে। সময়ের সাথে সমাজস্থরা সেই খাঁচার দেয়ালগুলো পুরু করছে।
মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া মানেই সে অন্যের ইচ্ছাধীন। তার নিজের মধ্যে কোনো ইচ্ছা জন্ম নেওয়া পাপ মনে করা হয়। অন্যের ইচ্ছার পুতুল হলে সে নারী লক্ষী। যে নারী সরাসরি ‘না’ বলতে পারে তার কিছু ইচ্ছা বাঁচে। কিন্তু যে লজ্জায় চোখ তুলতে পারে না, বুকের ভেতরের কথা মুখ পর্যন্ত আসে না তার ত্যাগের সীমা পরিসীমা নাই। সে মানাতে মানাতে জীবন পার করে দেয়। জন্মের পর বড় হতে হতে দেখেছি মায়ের কাছে যা দাবি করি তাই মেলে। রাতদুপুরে গরম ভাত মা দিতে পারেন। রাত জেগে মা বাতাস করতে পারেন। দরজা খুলে দেওয়ার জন্য মা সারারাত জাগতে পারেন। বাবার চোখ রাঙানি থেকে মা বাঁচাতে পারেন। মা মোটামুটি সর্বরোগের ওষুধ, সব সমস্যার সমাধান। কাজেই মায়ের কাছে প্রত্যাশা বেড়েই চলেছে এবং মায়ের ওপর চাপও বেড়েছে। মায়েদের জীবনে অবসর মেলে না।
রমণীর প্রিয় হয়ে থাকি, রমণীকে প্রিয় করে রাখি কি–না? সব ত্যাগ, ছাড় কেবল নারীকেই দিতে হবে। তার ইচ্ছার দু’পয়সা মূল্য থাকবে না এবং নারীর পছন্দ–অপছন্দ, মতামতের মূল্য শূন্য সংসারে–সমাজে এসবই তো দেখে এসেছি। আমরা স্ত্রী’র সুখ মাপার চেষ্টা করি পেশাকে। সময়ের বদলে কিনে আনি গহনা। অথচ সেও মানুষ এবং একটা মন বহন করে। সেখানেও রাগ– ক্ষোভ, অভিমান–অপমান ভর করে। তারও দুদিন অবসর কাটাতে ইচ্ছা হয়। আমাদের মায়েরা একজীবনের কোনদিন শুক্রবার–শনিবার পায়নি! অবসরের আশীর্বাদ তাদের জীবনে নামেনি। সকাল হতেই মায়েদের–মেয়েদের যে সংগ্রাম শুরু হয় সেখানে বাবাদের–পুরুষের সাপোর্ট খুব কম পেয়েছে। রাতে সবার শেষে ঘুমের সাথে তার দেখা হয়েছে। জন্মের পরেই যে সমাজ শিখিয়ে দেয় পুরুষ প্রভু আর নারী দাস– সে সমাজে সন্তানও সেটাই শেখে। চিন্তায় মুক্তি মেলে না।
নারীর অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়, আইন–মিছিল করতে হয়। কেন করতে হয়? পৃথিবীর একজন নারীও কি পরিবারবিচ্ছিন্ন? সন্তান জন্মদান করেনি এমন নারীর হার কত? স্বামী তার স্ত্রীর দরদ পুরোপুরি ধরেনি, সন্তান তার মাকে মূল্যায়ন করেনি। কেবল নারী হিসেবেই সমাজ নারীর সম্মান কমিয়ে রেখেছে। নারী তার গৃহে নিগৃহীত, কর্মস্থলে অনিরাপদ! পৃথিবীবাসী নারীকে তার শরীরের জন্য যতখানি মূল্যায়ন করেছে, মানুষ হিসেবে ততখানি মূল্যায়ন করেনি। তাইতো নারীকে অপমান বলা যায়। নারীর চাওয়া হত্যা করা যায়। নারীকে পণ্য ভাবা যায়। নারীর একটি ইচ্ছার মূল্য না দিয়েও তার সেবা পাওয়া যায়! যদি ভাবা হয় ভাত–কাপড়েই নারী সন্তুষ্ট, দু‘এক বাক্যের প্রশংসাতেই নারীর সব অধিকার আদায় হয়– তবে ভুল হবে। এই ভুলের খেসারত প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বয়ে বেড়াতে হবে।
নারী রানী হলেও লাভ নাই যদি তার সম্মান না থাকে। রাজা অত্যাচারী হলে রানীও তখন জীবন থেকে বাঁচতে চায়। মেয়ের–মায়ের, স্ত্রীর–বোনের এই চার শ্রেণির নারীর ইচ্ছার মূল্য দিলে, অধিকার আদায় করলে এবং মর্যাদা রাখলে পৃথিবীর সব নারীর অধিকার–সম্মান সুরক্ষিত হবে। সব নারী নিরাপদে বাঁচবে। কেবল ভাত–কাপড়ের মূল্যে একটা সমস্ত জীবন, সামগ্রিক ইচ্ছা–শখ কিনে নেওয়া ঠিক নয়। অবসর দেওয়া, সমর্থন করা এবং দরদ বোঝার চেষ্টা করা– নারীর অধিকারকেও মানুষের অধিকার ভাবা হোক। একটা সমগ্র জীবন কমেপ্রামাইজের পাহাড় গড়তে গড়তে যাবে, দাসীর মত সেবা করতে করতে যাবে আর বিনিময়ে ভালোবাসা পাবে না বরং অপমান হবে, অবহেলা/অবজ্ঞা পাবে– সভ্যতার আলোকে এসব ঠিক নয়। মানুষ হিসেবে তাদেরও পুরুষের মত ঘুরতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছে–পূরণ যাত্রায় নারীকে সাপোর্টে পুরুষের নাম থাকুক। এক জীবনের সকল ভালো কাজে সবাই সবার সমর্থন–সহায়তা পেলেই মানবিকতার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব। নয়তো সৃষ্টির অর্ধাংশ অন্ধকারেই থেকে যাবে। যে অন্ধকারে অমানবিকতার ছায়া পড়বে।