গত মাস দুয়েকের ভেতর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ঘটা কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা পরপর লিখছি। হয়তো এর সব ক’টা খবরই বিস্তারিতভাবে আমরা পত্রিকায় বা ফেসবুকে পড়েছি। ঘটনাগুলো এরকম, ঢাকার পান্থপথ মোড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তরুণ চলচ্চিত্রনির্মাতা ও নারী অধিকার কর্মী অপরাজিতা সঙ্গীতাকে। পথচলতি একজন বয়স্ক ব্যক্তি সঙ্গীতাকে ওড়না ছাড়া পোশাক পরায় অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। এই কাজ করেই ক্ষান্ত হয়নি সেই বয়স্ক ব্যক্তি, এক পর্যায়ে গাড়ির জানালায় থুতু দিয়ে চলে যায়। অন্য এক ঘটনায়, দেশের বিশিষ্ট পর্বতারোহী শায়লা বীথি ধানমন্ডির একটি ফুটওভার ব্রিজ পার হওয়ার সময় প্রকাশ্য দিবালোকে একদল পুরুষের দ্বারা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হন। হামলায় আহতও হন তিনি। এদিকে, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দুই নারীকে মারধর ও হয়রানির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার কয়েকটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে যায়। স্ট্রিট ফুডের দোকানে পরিবারের সঙ্গে খাবার খাওয়ার সময় হিজাব না থাকায় হয়রানির মুখে পড়তে হয় আরেক নারী সাংবাদিককে। এসবের বাইরে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুক্তভোগী নারীরা জানাচ্ছেন, দূর থেকে ছুড়ে দেওয়া কটু মন্তব্য, অসৌজন্যমূলক কথাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানির ঘটনা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। একজন নারী জানান, কপালে টিপ পরার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাকে। আরেকজন জানান, চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বোরকা না পরার কারণে হয়রানির শিকার হতে হয় তাকে। আরও অনেকেই পথে চলার সময় কটুকথা শোনার অভিজ্ঞতার কথা জানান।
বেশ কিছুদিন ধরেই অনেক নারী এভাবে পথেঘাটে হয়রানির মুখোমুখি হওয়ার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করছেন। গত ৫ আগস্ট দেশে পট পরিবর্তনের পর থেকেই এ ধরনের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে বলে তারা জানাচ্ছেন। অনেকেই বলছেন, রাস্তাঘাটে পুলিশের উপস্থিতি কম থাকায় একশ্রেণির মানুষ নির্ভয়ে এই অপরাধগুলো করছেন। তাদের কাছে নারীরা সহজ টার্গেট। শুধু রাজধানীতেই নয় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও পথেঘাটে একই কায়দায় হয়রানির ঘটনার কথা তুলে ধরছেন নারীরা। নারীদের সরাসরি চলাচলে বাধা দেওয়া, বাজে মন্তব্য করা এমনকি শারীরিক ও যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটছে। পথেঘাটে নারীদের প্রতি এক শ্রেণির পুরুষের বৈষম্যমূলক আচরণের এই অভয়ারণ্যে ভুক্তভোগী নারীরা প্রতিবাদ করার সাহসও হারিয়ে ফেলছেন। কারণ প্রতিবাদ করলে আশপাশের লোকজনের সমর্থন পাওয়া তো দূরের কথা বরং তারা এখন হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কাও করছেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার পরও কেন এই পরিস্থিতির উন্নতি হলো না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নারী অধিকার কর্মীরা। সরকারের উপদেষ্টারা কেন এই ঘটনাগুলোর নিন্দা জানিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছেন না সেদিকেও আঙুল তুলছেন তারা। যে সংখ্যায় ঘটনাগুলো ঘটছে তাতে সরকারের নীরবতা গ্রহণযোগ্য নয়। জুলাই–আগস্ট ছাত্র–গণঅভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং আন্দোলনের ফল। কিন্তু ছাত্র–গণঅভ্যুত্থানে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের যে আশা জেগে উঠেছিল তা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী নারীদের ওপর একের পর এক হামলা, নির্যাতন–নিপীড়ন–হেনস্তার ঘটনায় আশার বদলে উদ্বেগই বাড়িয়ে তুলছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, অভ্যুত্থানের পর নারী হেনস্তার পর পর কয়েকটি ঘটনার ধরণ দেখে মনে হয়েছে যে এসবই পরিকল্পিত এবং সমাজে নারীদের স্বাভাবিক চলাফেরায় ভীতি সঞ্চার করতেই ঘটনোগুলো ঘটানো হয়েছে। এই ধরনের নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলোর পাশাপাশি দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্করতম নারী নির্যাতন–সহিংসতার ঘটনাও নিয়মিতই ঘটেছে এসময়। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, পথ হারানো এক কিশোরী দু’দফায় দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন চট্টগ্রামে, পাবনার সাঁথিয়ায় সাত বছরের এক শিশু ধর্ষিত হয়েছে, চলন্ত বাসে এক নারী চালক ও সহকারীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন চট্টগ্রামে, ভয়াবহতম বন্যার মধ্যে কুমিল্লার তিতাস উপজেলায় ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
কিন্তু কেন? গণমানুষের যে সরকার, বৈষম্য বিরোধী যে সরকার, জন কল্যাণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসা সরকারের সময়ে তো এসবই হ্রাস পাওয়ার কথা! পরিস্থিতি উত্তরণের পথে হাঁটার কথা! তাহলে গলদটা কোথায়? গলদ কোথায় সেটা খুব দ্রুতই খুঁজে বের করতে হবে এবং সামাল দিতে হবে। নয়তো নারীর প্রতি সহিংসতা আরও নগ্ন রূপ ধারণ করবে এবং একদিন হয়তো এমন সময়ও দেখতে হতে পারে যে প্রতিটি পরিবারেরই কোনো না কোনো নারী সদস্য নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।