(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সুঝৌ শহরের এনসাইয়েন্ট সিটিতে ঘুরছি। সুঝৌ চীনের সাংহাই শহর থেকে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার দূরের একটি শহর। আরো বহু কিছু এই নগরীতে থাকলেও আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন ‘এনসাইয়েন্ট সিটি’ই সুঝৌকে ভিন্ন উচ্চতায় আসীন করেছে। আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন এই শহরটিকে জাতিসংঘ বিশ্ব ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ঐতিহ্য সংরক্ষণে চীনাদের যে সর্বাত্মক চেষ্টা তা সত্যিই মুগ্ধ করলো আমাকে। হাত বাড়ালে সারি সারি সুউচ্চ ভবন থাকলেও পাশের এনসাইয়েন্ট সিটির টালির ঘরগুলো চৈনিক সভ্যতার আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
ছোট্ট একটি এলাকাকে ঘিরে ধরে রাখা প্রাচীন জনপদই মূলতঃ এনসাইয়েন্ট সিটি। আর এই এনসাইয়েন্ট সিটি দেখার জন্য চীনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ সুঝৌতে ভিড় করেন। তারা এনসাইয়েন্ট সিটিতে প্রাচীন চীনের কৃষ্টি সভ্যতা ও জীবনযাত্রাসহ সবকিছু খুব কাছ থেকে ঘুরে ঘুরে দেখেন। মাত্র ১.৬ বর্গ কিলোমিটারের একটি এলাকা এই এনসাইয়েন্ট সিটি। যেখানে আধুনিকতার কোন প্রবেশ নেই, এমনকি ইঞ্জিনও পুরোপুরি নিষিদ্ধ। নেই কোন যানবাহন, জেনারেটর বা অন্য কিছু। আড়াই হাজার বছর আগে চীনের মানুষ যেভাবে বাড়িঘর বানাতেন, যেভাবে জীবনযাপন করতেন ঠিক সেভাবেই সবকিছু ধরে রাখা হয়েছে।
ওই সময়কার মানুষ যেই রাস্তাটি ধরে হাঁটতেন ঠিক সেই সড়কটি রয়েছে। সরু একটি সড়ক,৭/৮ ফুট চওড়া হতে পারে। শত শত মানুষ সেই সরু সড়কটি ধরেই পথ চলেন, গিজগিজ করেন। সড়কটির একপাশেই ঘরবাড়ি, দোকানপাট, অপরপাড়ে স্বচ্ছ পানিতে ভরা একটি খাল। এই খালটিই এলাকার মানুষের আয়েশী চলাচলের একমাত্র মাধ্যম। হয় সড়কে ঘাম ঝরিয়ে গতর খাটিয়ে হাঁটুন, অন্যথায় লগি–বৈঠার নৌকায় চড়ে আয়েশ করে ঘরে গন্তব্যে যাতায়াত করুন। নৌকার নাম সোয়ান। এক একটি সোয়ানে ১০/১২জন যাত্রী বসতে পারে, মাঝী একজন। ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগে পুরো এলাকা ঘুরতে। স্থানীয় লোকজন সোয়ান ব্যবহার করে কিনা জানি না, তবে পর্যটকদের অনেককেই লাইন ধরে সোয়ানে চড়তে দেখা গেছে। টলটল করা পানিতে নৌকায় ভাসতে ভালো লাগার কথা। তবে আমরা নৌকায় চড়লাম না। শত শত পর্যটক আড়াই হাজার বছরের আগেকার বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে সোয়ানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
আমরা পায়ে হেঁটে হেঁটে এনসাইয়েন্ট সিটি দেখছিলাম। দেখছিলাম মানুষসহ নানা কিছু। সরু রাস্তাটির পাশে অনেক দোকান। ওই সময়কার নানা খাবার দাবারের পাশাপাশি আধুনিক খাবার দাবারও বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বহু খাবারই মানুষ কিনে খাচ্ছে। আমরাও ওদিকে গেলাম না। এতো প্রাচীন খাবারের জাতপাতের কিছু বুঝবো না বলেই আমরা আধুনিক খাবারের দিকে ঝুঁকলাম। একটি রেস্টুরেন্ট থেকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং কফি নিলাম। ডালিয়া ভাবী আইসক্রিম খেলেন। আমাদের কলম্বিয়ান দম্পতিকেও খাওয়ালাম। বাসে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই তারা আমাদের সাথে নানা খোশগল্প করছিলেন, বাস থেকে নামার পরও আমাদের সাথে এনসাইয়েন্ট সিটিতে ঘুরছেন। আমাদের প্রটোকলে থাকা চীনা তরুণী ফ্রাঞ্চি এবং শাসা নিজেদের মতো করে কি কি সব খাচ্ছিল। তারা আমাদেরকেও নানা খাবার অফার করছিল।
খালটির বিপরীত পাশে কোন দোকানপাট নেই, সেখানে সবগুলো বাড়িঘর। আবাসন, ইট সুরকির টালির বাড়ি। সেগুলো ঠিক আড়াই হাজার বছর আগেকার বাড়ি কিনা জানি না, তবে একেবারে লক্কর ঝক্কর অবস্থায় রয়েছে। বাড়িঘরের আদলে আধুনিকতার কোন চিহ্নই নেই, সবই পুরানো। বাড়ির দাওয়ায় বসে অনেকেই গল্প করছেন। অনেকেই কি কি সব খাওয়া দাওয়াও করছেন। শিশুরা হাসছে, খেলছে।
খালটি তেমন চওড়া নয়, আমাদের চাক্তাই খালের চেয়ে সরু, ৩০ ফুটের মতো হতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, খালের পানিতে ছোট ছোট মাছ খেলা করছে। খালের একেবারে নিচে যেসব মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে সেগুলোও দেখা যাচ্ছিল। খালের পানি এতো স্বচ্ছ হতে পারে তা আমার ধারণাতেও ছিল না। বিশেষ করে এমন ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় এমন টলটলে পানি ভর্তি খাল বিস্ময় জাগাচ্ছিল। সত্যি বলতে কী– এমন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন খাল আমি কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। অথচ খালটির পাড়ে শুধু দোকানপাট বা বাড়িঘরই নয়, খালের উপর ঝুলে আছে বড় বড় গাছ, গাছের শাখা প্রশাখা। রয়েছে গাছভর্তি পাতাও। এসব গাছের ঝরা পাতা কোথায় পড়ে! নিজেকে প্রশ্ন করলাম। উত্তরও নিজে নিজে দিলাম যে, নিশ্চয় খালে। তাহলে খালে পাতা নেই কেন? ময়লা নেই কেন? পচা পাতার যে আস্তর খালের পানির নিচে থাকার কথা তা গেল কই?
প্রশ্নের উত্তর পেতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটি সোয়ান একাই চালাচ্ছিলেন মাঝবয়সী এক ব্যক্তি। অনেক সোয়ানের ভিতরে কেবলমাত্র ওই সোয়ানটিই দেখলাম যাত্রীশূন্য। বুঝতে পারলাম যে, নৌকা নিয়ে খালে খালে ভাসছেন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। সোয়ানের মাঝীই স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিয়োগ দেয়া পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তিনি বিশেষ ধরনের একটি চাকনি কঞ্চির ডগায় বেঁধে নিয়েছেন। যেটি দিয়ে খালে পড়া সব ময়লা এমনকি গাছের পাতাও টুক টুক করে তুলে সোয়ানে রাখছিলেন। যে কোন ময়লা চোখে পড়ার সাথে সাথে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সাথে সাথে চাকনি দিয়ে তুলে নিচ্ছেন। এই ধরনের পরিচ্ছন্নতা অভিযান বহাল থাকায় খালে ময়লা নেই, নেই গাছের একটি পাতাও। এতে পানি শুধু পরিচ্ছন্ন নয়, জলজপ্রাণীর বাসযোগ্যও থাকছে। খালের পানিতে মাছের আনাগোনা পর্যটকদেরও মুগ্ধ করছে।
হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যাথা হয়ে যাচ্ছিল। বসার জায়গা টায়গাও আছে। মনে হলো তাও যেনো সেই আগেকার মতো। আমি খালের উপর নির্মিত ধনুক টাইপের একটি সেতুর রেলিংয়ের উপর বসে পড়লাম। সেতুটি কখনকার কে জানে, তবে বহুদিনের যে পুরানো তা বুঝা যাচ্ছিল। এই সেতুর সাথে ইতালীর ভেনিসের সেতুগুলোর ডিজাইনের বেশ মিল দেখলাম। কে যে কার কাছ থেকে ডিজাইন নিয়েছে কে জানে। মাঝখানে নৌকা চলাচলের জন্য কিছুটা উঁচু করে দেয়া!
অনেকক্ষন বসে থাকলাম। লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবীও বসলেন আমার পাশে। বুঝতে পারছিলাম যে হাঁটতে হাঁটতে তাদের অবস্থাও শোচনীয়। তবে চীনা দুই প্রটোকল তরুণী এবং কলম্বিয়ান দম্পতির পায়ের জোর প্রচন্ড। তারা হাঁটছিলেন। ভিড়ের মধ্যে কে যে কোনদিকে চলে গেলেন বুঝতে পারছিলাম না। করিম ভাই শাসার সাথে ফোনে কথা বললেন। আমরা সড়কটির শেষ মাথায় গিয়ে অপেক্ষা করবো বলেও জানিয়ে দিলেন তিনি।
আমরা পাশের একটি দোকানে ঢুকে পড়লাম। কাঠের বিভিন্ন কারুকাজ বিক্রি করছে দোকানটি। ফটো ফ্রেম থেকে ফার্নিচার। গলার মালা, হাতের বালা থেকে শুরু করে হাতি, ঘোড়া, পাখি ও ড্রাগনসহ নানা প্রাণীর হুবহু আদল তৈরি করা হয়েছে কাঠ দিয়ে। কাঠ খোদাই করে এতো সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরি করা হয়েছে যে চোখ ফিরানো যাচ্ছিলো না। এক চীনা তরুণী দোকানে এসব পণ্য বিক্রি করছিলেন। তবে খুব বেশি ক্রেতা না থাকায় তরুণী আমাদের দেখে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলেন। বিদেশী লোকের মুখে চীনা ভাষা শুনায় তরুণী বেশ আগ্রহ নিয়ে লায়ন ফজলে করিমের কথা শুনছিলেন। তিনি আমাদেরকে এক্সক্লুসিভ কিছু জিনিসপত্র দেখিয়ে বললেন, এগুলো এক হাজার বছরের পুরানো কাঠ দিয়ে তৈরি। লাইফ টাইমে এগুলোর কিচ্ছু হবে না। এমনকি রঙও পরিবর্তন হবে না। এগুলোতে কোন রঙ ব্যবহার করা হয়নি, কাঠে ঘষে ঘষে রঙ সৃষ্টি করা হয়েছে। পুরোটিই হাতের কাজ।
তরুণী আমাদেরকে একটি ডাইনিং টেবিল ও ছয়টি চেয়ার দেখালেন। ছোট্ট, গোলাকার। তবে বেশ আশ্চর্য হলাম যে, ৬টি চেয়ারই টেবিলের তলায় কেমন করে যেনো সেট হয়ে রয়েছে। দেখতে মনে হবে গোলাকার একটি কাঠের টুকরো, অথচ তার ভিতর থেকে চোখ ধাঁধানো ছয়টি চেয়ার বের করে একটি ডাইনিং টেবিল হয়ে গেল। দাম জিজ্ঞেস করে যেটি জানলাম তাতে আমার ভিতরটি চমকে উঠলো। ছয়টি চেয়ারসহ ডাইনিং সেটের দাম মাত্র ৫ লাখ ৮০ হাজার আরএমবি বা প্রায় এক কোটি টাকা!
আমাদের চেহারা দেখে তরুণী যা বুঝার বুঝে গেলেন। বড়সড় একটি ঈগল যেনো চোখ শক্ত করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কাঠের ঈগল হলেও প্রথম দেখায় তা বুঝার কোন উপায় নেই। মনে হচ্ছিল জ্যান্ত ঈগলটি এখনই হামলে পড়বে। চোখ দুইটিও যেনো রাগে ভরা। আমি হাত ছুঁইয়ে ঈগলটিকে আদর করে দিলাম। তরুণী জানালেন, এটিতেও কোন রঙ ব্যবহার করা হয়নি। পুরোটাই হাতের কাজ। এক হাজার বছরের পুরানো কাঠ খোদাই করে ঈগলটি তৈরি করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে দাম জানতে চাইলাম। যা বললেন, তাতে সত্যি সত্যি বুকটি কেঁপে গেল। মাত্র ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা! তরুণী জানালেন, এটি চীনেই বিক্রি করতে হবে। বাইরে রপ্তানি করা যাবে না। রপ্তানি করতে পারলে আরো বেশি দামে বিক্রি করা সম্ভব হতো। তরুণী যা জানালেন, তাদের পণ্য বিশ্বের নানা দেশে রপ্তানি হয়। তবে কিছু কিছু পণ্যের ব্যাপারে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকার এই ঈগল তার মধ্যে একটি। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।