জুম্‌’আর খুতবা

কুরআন ও হাদীসের আলোকে শোকর ও সবর মু’মিনদের দুটি গুণ

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৮ নভেম্বর, ২০২৪ at ৭:২০ পূর্বাহ্ণ

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! জেনে রাখুন, সমগ্র সৃষ্টি রাজিতে আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামত বিদ্যমান। তাঁর নিয়ামতের সংখ্যা নিরূপন করা বান্দার সাধ্যাতীত। বান্দা মহান প্রভূর কি পরিমাণ নিয়ামত দিবারাত্রি সকাল সন্ধ্যা প্রতিনিয়ত ভোগ ও ব্যবহার করছেন তা গণনা ও বর্ণনার বাইরে। বান্দার দায়িত্ব হলো নিয়ামত দাতা, রিযিকদাতা, পালনকর্তা, সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

শোকর অর্থ: শোকর আরবি শব্দ, এর অর্থ নিয়ামত লাভ করার পর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। প্রচলিত অর্থে কারো অনুগ্রহ অনুদান ও সাহায্য সহযোগিতা প্রাপ্তির পর দাতার প্রতি কথায় কাজে ব্যবহারে তাঁর দান অনুদান স্বীকার করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাকে শোকর বলা হয়। ইসলামে শোকর আদায় করার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো নিয়ামতের মালিক মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে “আলহামদুলিল্লাহ” বলা।

পবিত্র কুরআনের আলোকে শোকর আদায়ের নির্দেশনা: নিয়ামত দাতার শোকরিয়া আদায় করার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। বান্দার জীবন ধারণের জন্য যতসব প্রয়োজনীয় উপাদান সবগুলো মূলত মহান আল্লাহর সৃষ্টি। বান্দার অস্তিত্ব আল্লাহর কুদরতের বিস্ময়কর সৃষ্টি, বান্দার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, ধারণশক্তি, অনুভূতি, উপলব্ধি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন, গমনাগমন, বিচরণ, সব কিছু, সক্রীয়, সচল ও কার্যকর থাকার মাধ্যমে জীবনকে উপভোগ করা একমাত্র আল্লাহর দান। বান্দার শৈশব কিশোর যৌবন ও বার্ধক্যে সর্বাবস্থায় আল্লাহর দয়া অনুগ্রহে পরম করুণায় তাঁরই প্রদত্ত সর্বপ্রকার নিয়ামত ভোগ ও ব্যবহার করার বিনিময়ে তাঁরই ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি অর্জনের প্রত্যয়ে তাঁকে স্মরণ করা তাঁর প্রতি শোকর আদায়ের নামান্তর। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, “অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদের স্মরণ করব। আর আমার শোকর আদায় কর, আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়োনা। (সূরা: বাক্বারা, :১৫২)

শোকর আদায় করলে নিয়ামত বৃদ্ধি পায়: শোকর আদায়কারী আল্লাহর অনুগত ও প্রিয়ভাজন হয়ে থাকে। মু’মিন বান্দা নিয়ামত লাভের পর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে আরো সক্রীয় ও তৎপর হয়ে উঠে। ইবাদত বন্দেগী ও ইসলামী জীবনাদর্শে নিজের জীবনকে আলোকিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত করার লক্ষ্যে আরো অধিক মনোযোগী হয়। বান্দা যতবেশি আল্লাহর শোকর আদায় করবে মহান আল্লাহ বান্দাকে আরো অধিক পরিমান নিয়ামত বাড়িয়ে দেন, বান্দার মানমর্যাদা সম্মান সুনাম বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর যখন তোমাদের প্রভূ ঘোষণা দিলেন, যদি তোমরা শোকর আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব। আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার শাস্তি বড় কঠিন।” (সূরা: ইবরাহীম: ১৪:)

হালাল রিযক ভক্ষণ করা ও শোকর আদায় করার নির্দেশনা: আল্লাহর দরবারে বান্দার ইবাদত বন্দেগী নামায রোযা হজ্ব যাকাত সমাজ সেবা জনসেবা দানশীলতা কবুল হওয়ার জন্য হালাল উপার্জন ও হালাল রিযক ভক্ষণ অপরিহার্য। যিনি হালাল রিযক উপার্জন ও ভক্ষণ করার তাওফিক দিয়েছেন সেই আল্লাহর শোকর আদায় ইবাদতের শামিল। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “অতএব আল্লাহ তোমাদের যে হালাল উত্তম রিযক দিয়েছেন তোমরা তা থেকে আহার কর। এবং আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় কর। যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করে থাক। (সূরা: নাহল: ১৬:১১৪)

হাদীস শরীফের আলোকে শোকর আদায়কারী বান্দার জন্য পুরস্কার: আল্লাহর কাছে বান্দার প্রতিটি ভালো কাজের উত্তম পুরস্কার রয়েছে। বান্দার কোনো নেক আমল আল্লাহ বিনষ্ট করবেন না। শোকর আদায়কারী বান্দার প্রতিদান প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কৃতজ্ঞ আহারকারীর জন্য ধৈর্যশীল রোযাদারের ন্যায় পুরস্কার রয়েছে। অর্থাৎ একজন ধৈর্যশীল রোযাদার যে পরিমাণ পুরস্কার পাবে যে ব্যক্তি পানাহারের পর মহান আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করে সেও ঐ পরিমাণ পুরস্কার পাবে। (সহীহ বুখারী)

মানুষের উপকার স্বীকার করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা: মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, যে মানুষের উপকার ও কল্যাণে এগিয়ে আসবে সে উত্তম মানুষ। মানুষের উচিত যে কারো উপকার পাবে উপকার স্বীকার করা। উপকার ভুলে যাওয়া চরম অন্যায় ও মানবতা বিরোধী আচরণ যা গর্হিত ও পরিত্যাজ্য। এ শ্রেণির মানুষ গুলো সমাজের কলংক ও ঘৃণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হযরত আবু সাইদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের (শোকর) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেনা সে আল্লাহর (নিয়ামতের) কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করতে পারেনা। (তিরমিযী, হাদীস: ১৯৫৫)

যে ভাবে আল্লাহর শোকর আদায় করা জরুরি তদ্রুপ মানুষের শোকর তথা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাও আবশ্যক।

শোকর সম্পর্কে হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (.)’র নির্দেশনা: হযরত শায়খ জিলানি (.)’র মতে শোকর তিন প্রকার। ১. জিহবা দ্বারা শোকর আদায় করা, . দৈহিক ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দিয়ে শোকর আদায় করা, . কলব দিয়ে শোকর আদায় করা, তা হলো হারাম থেকে বেঁচে থাকতে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। (আল গুনইয়া ২/১৯৩১৯৪)

শোকরকারীদের প্রকারভেদ: হযরত শায়খুল মাশায়েখ বড়পীর আবদুল কাদের জিলানি (.) শোকর কারীদের তিন ভাগে বিন্যস্ত করেছেন। ১. আমলকারী, এ শ্রেণির বান্দারা নেক আমলের মাধ্যমে শোকর আদায় করে। ২. আবিদ বান্দাদের শোকর, এ শ্রেণির বান্দারা ফরজ ইবাদত আদায়ে সচেষ্ট থাকে যত্নবান থাকে, ইবাদতের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকে। ৩. আরিফীন বান্দাদের শোকর, আল্লাহর অলীগন এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা আল্লাহর ফায়সালার উপর অটল অবিচল থাকেন। তারা আল্লাহর ইবাদত আনুগত্যে নিয়োজিত থেকে শোকর আদায় করে। (শায়খ আবদুল কাদের জিলানি: ৬২১, আল গুনইয়া: /১৯৪)

সবর প্রসঙ্গ: অভাব অনটন, বালা মুসীবত, বিপদআপদ, কঠিন ক্রান্তিকাল ও প্রতিকূল অবস্থায় ধৈর্যধারণ করার নাম সবর। রোগে শোকে, ক্ষুধা যন্ত্রণায়, জুলুম নির্যাতনে অস্থির না হয়ে আল্লাহর উপর নির্ভর করে সব কিছু সহ্য করে অটল অবিচল থাকার নাম সবর। সবর, আরবি শব্দ এর আভিধানিক অর্থ আটকে রাখা, বেঁধে রাখা। শরয়ী পরিভাষায় তিনটি বিষয়ে নিজকে আটকে রাখা বা বেঁধে রাখার নাম “সবর” বা ধৈর্য। ১. আল্লাহ তা’আলার বিধিবিধান পালনে নিজেকে আটকে রাখা, . আল্লাহর নিষিদ্ধ পথে যেতে নিজেকে আটকে রাখা, . বিপদ আপদ দুঃখ দুর্দশার মুহূর্তে অবাঞ্চিত অসঙ্গত ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা বা আটকে রাখা।

ধৈর্য ধারণে আল কুরআনের নির্দেশনা: নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের জন্য চরম অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছেন। ওহুদের ময়দানে দান্দান মুবারক শহীদ করেছেন। তায়েফের ময়দানে রক্তাক্ত হয়েছেন, নিজ মাতৃভূমি মক্কা ত্যাগ করেছেন। তিনি ছিলেন ধৈর্যের এক উজ্জ্বল অনুকরনীয় মডেল উত্তম আদর্শ। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে প্রিয় নবী! আপনি সবর করুন, আর আপনার সবর কেবল আল্লাহর জন্য। (সূরা: নাহল:১২৭)

সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা: সবর ও সালাত দুটি উত্তম আমল। এ বরকতময় আমলের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সাহায্য লাভে সমর্থ হয়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগন, ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সূরা: বাক্বারা, :১৫৩)

ধৈর্যশীলদের জন্য সুসংবাদ: মু’মিনদের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে পরীক্ষা। বিভিন্ন ঘটনা দুর্ঘটনা দু:খ বেদনা, যন্ত্রণা নানাবিধ বাঁধা বিপত্তি সমস্যা সংকট প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ধৈর্যের চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই আসবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ও সুসংবাদ। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয় ক্ষুধা, ধন সম্পদ জীবন ও ফল ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা আর আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের। (আল কুরআন, সূরা: বাক্বারা, ১৫৫)

বিপদ আপদে সবর করলে গুনাহ মাফ হয়: বিপদে ধৈর্যধারণ মু’মিনের বৈশিষ্ট্য। মু’মিন সর্বদা আল্লাহর উপর অটল অবিচল থাকেন। আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর অটুট থাকেন, বিভিন্নমূখী বিপদ সংকুল পরিস্থিতির মুখোমুখী হয়েও ধৈর্যচ্যূত হন না। এ ধৈর্যের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন, তাঁর গুনাহ মাফ করেন। হে আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের উপর অটল রাখুন। শোকর ও সবর অবলম্বন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

কাজী আবদুর রশীদ নেজামী

কমল মুন্সির হাট, চক্রশালা, পটিয়া, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: খতনা করা সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা সংক্ষেপে জানালে উপকৃত হব।

উত্তর: ইসলামী শরীয়তে খত্‌না করা সুন্নাত। আমাদের দেশে খতনাকে মুসলমানী বলা হয়। হাদীস শরীফের বর্ণনা দ্বারা প্রমানিত খতনা করা পূর্ববর্তী আম্বিয়া কেরামের সুন্নাত। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, পাঁচটি বিষয়ে স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। যা নবী গণের আলাইহিমুস সালাম’র সুন্নাত। খতনা করা, নাভীর নীচের লোম পরিষ্কার করা, গোফ ছোট করা, নখ ছোট করা, বগলের নীচের লোম পরিষ্কার করা। (সহীহ মুসলিম, হাদীস:-২৫৭); পিতা বা অভিভাবকের দায়িত্ব হলো সাত বছর থেকে ১২ বছর বয়সের মধ্যে ছেলের খত্‌না করানো। তবে জন্মের ৭ দিনের পর খতনা করানো জায়েজ। (বাহারে শরীয়ত ১৬ তম খন্ড, আলমগীরি, খন্ড: , পৃ:৩৫৭)

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুফি-আউলিয়ার দরবার : সকল সমপ্রদায়ের নিরাপদ আশ্রয়স্থল
পরবর্তী নিবন্ধদুই মাস পর রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের ঘরে