শাহ আমানত সেতুতে মাসিক আয় ৭.৫ কোটি, টানেলে ক্ষতি ৮ কোটি!

অবকাঠামোর বিপরীতমুখী চিত্র!

জে. জাহেদ, নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার , ৭ নভেম্বর, ২০২৪ at ৩:০০ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের শাহ আমানত তৃতীয় সেতুর টোলপ্লাজায় গত অক্টোবর মাসে আয় হয়েছে ৭ কোটি ৩১ লাখ ৪২ হাজার ৩৭৭ টাকা। এতে বিভিন্ন যানবাহন (গাড়ি) সেতু দিয়ে চলাচল করেছে ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৬৩৮ টি। অথচ কর্ণফুলী নদীর তলদেশে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা দিয়ে নির্মিত টানেলে দৈনিক আয় হচ্ছে মাত্র ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা এবং দিনে ব্যয় হচ্ছে ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। সে হিসাবে আয় ব্যয় মিলাতে গেলে দেখা যায়, মাসে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা (প্রায়)।

সেক্ষেত্রে প্রতিমাসে শাহ আমানত তৃতীয় সেতু (নতুন ব্রিজ) দৈনিক ও মাসিক সর্বোচ্চ সংখ্যক প‌রিবহন পারাপার হচ্ছে। ফলে, দক্ষিণ চট্টগ্রামকে সংযুক্ত করা এ সেতুতে টোল আদায়ে রেকর্ড সৃ‌ষ্টি হয়েছে।

সেতুর সব কিছু সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ কতৃক সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও টোল আদায়ে স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে বলে জানান টোল প্লাজার ইজারাদার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কোম্পানি সেল-ভ্যান জেভি’র প্রজেক্ট ম্যানেজার সুমন ঘোষ।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে কর্ণফুলী ব্রিজ টোলপ্লাজা দিয়ে যানবাহন চলাচল করেছেন ৭ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৬ টাকা আর টোল আদায় হয়েছে ৬ কোটি ৭১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৭৬ টাকা।

টোলপ্লাজার রেডিনিউ আর ট্রাফিকের মাসিক এনালাইসিস তথ্য বলছে, ২০২১ সালে শাহ আমানত সেতুতে আদায় হয়ে ছিলো ৭১ কোটি ৩৭ লক্ষ ৯ ৬৬৫ টাকা আর যানবাহন চলে করেন ৭৫ লাখ ৫২ হাজার ৫২৯ টি, ২০২২ সালে আদায় হয়েছে ৭৮ কোটি ৮৪ লাখ ৭৭ হাজার ৩৫২ টাকা ৫০ পয়সা আর যানবাহন চলাচল করেছে ৮৩ লাখ ৮৯ হাজার ১৪২ টি।

এছাড়াও গত ২০২৩ সালে আদায় হয় ৭৯ কোটি ১৯ লাখ ৮ হাজার ৩৮৭ টাকা ৫০ পয়সা আর যানবাহন চলাচল করেছে ৯১ লাখ ২ হাজার ৪২৫ টাকা। সে হিসেবে ২০২৪ সালের জানুয়ারী থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আয় হয়েছে ৬৪ কোটি ৪৯ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৪ টাকা। আর সেতু দিয়ে এ বছরে গত ১০ মাসে যানবাহন চলাচল করেছে ৭৪ লাখ ১৪ হাজার ৫৮৩ টি।

অপরদিকে, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এই টানেলটি উদ্বোধনের পর থেকে দৈনিক আয় ব্যয়ের যে হিসাব দিচ্ছে টানেল কর্তৃপক্ষ ও সেতু কর্তৃপক্ষ জানান, গত ২২ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় এক বছরের গাড়ি চলাচল ও আয় ব্যয়ের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে। এই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এই টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় এক বছরে গাড়ি চলাচল করেছে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি। যার মধ্যে মধ্যে ৭৬ শতাংশই ছিল হালকা যান বা ছোট গাড়ি।

বাসের পরিমাণ ১০ শতাংশ, ট্রাক ১২ শতাংশ। আর অন্য বড় ট্রেইলারের পরিমাণ এক শতাংশেরও কম। টানেল কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, প্রতিদিন গড়ে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে তিন হাজার ৯১০টি। টানেল কর্তৃপক্ষের দেয়া হিসাব বলছে, এখন পর্যন্ত গত এক বছরে এই টানেল থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেল থেকে টোল বাবদ আয় হচ্ছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।

কিন্তু মাটির তলদেশে নির্মিত টানেল হওয়ায় প্রতিদিন টানেলে কৃত্রিম অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা বাবদ একটা বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেলটির এসব ব্যয় নির্বাহে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।

ঋণের টাকায় নির্মিত হওয়ায় এই প্রকল্প থেকে থেকে আয় তো দূরের কথা, প্রতিদিনের ব্যয়ও তোলা সম্ভব না হওয়ায় টানেলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সেক্ষেত্রে শাহ আমানত তৃতীয় সেতুর টোলপ্লাজায় বেশ সচল। আদায়ও টানেল অপেক্ষা খরচসহ সব মিলিয়ে সন্তোষজনক বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

সেতুর টোল আদায় প্রসঙ্গে শাহ আমানত তৃতীয় সেতুর টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠান ‘সেল ভ্যান জেভি’র প্রজেক্ট ম্যানেজার সুমন ঘোষ বলেন, শাহ আমানত সেতুতে ক্যাশলেস ও সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজ পদ্ধতিতে টোল আদায় হয়। এখানে প্রতি মাসে প্রায় ৬ থেকে ৭ কোটি টাকা টোল আদায় হয়। এ বিষয়টি ঢাকা সচিবালয় ‘এমআইএস’ থেকে সরাসরি মনিটরিং করা হয়। একই সঙ্গে সড়ক ও জনপথ, চট্টগ্রাম অফিস থেকেও এটি মনিটরিং করা হয়। টাকার সাথে টোকেন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রয়েছে ক্যাশলেস সেবাও। তবে এ বিষয়ে জনগণের সচেতনতা হওয়া উচিত বলে মনে করছি।’

অন্যদিকে, সেতু আর টানেল বিষয়ে যোগাযোগ বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যে পরিমাণ গাড়ি চলাচল করছে ও আয় হয়েছে সেটি আস্তে আস্তে আরো কমতে পারে। উদ্বোধনের পর প্রথম মাস অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরে টানেলে গাড়ি চলাচল করেছে এক লাখ ৬৬ হাজার ৩১২টি। সে হিসেবে ওই মাসে প্রতিদিন গাড়ি চলেছে পাঁচ হাজার ৫৪৪টি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ‘টানেল নির্মাণ হচ্ছে একটি দূরদর্শী প্রকল্প। এটির পরিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য মিরসরাই শিল্পনগর থেকে আনোয়ারা-বাঁশখালী হয়ে পেকুয়া-মাতারবাড়ী-কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করতে হবে। এই এলাকাজুড়ে শিল্পায়ন, পর্যটন ও আবাসন এলাকা গড়ে উঠবে ভবিষ্যতে। তবে সময় লাগবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং মিরসরাই শিল্পাঞ্চল চালু হলে টানেলের ব্যবহার আরও বাড়বে। এটা আগামী ১০০ বছর ধরে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখবে। সেদিক থেকে এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নেই তা বলা যাবে না। তবে প্রকল্পের খরচ নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন।’

একই বিষয়ে অধ্যাপক সামসুল হক বলেন, ‘টানেলটি চালুর পর বাইসাইকেল, সিএনজি ও মোটর সাইকেলের মতো যানবাহনগুলো চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সার্বজনীন না হওয়ায় পরিবহনের সংখ্যা কমছে। এছাড়া কর্ণফুলী টানেলের ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে শাহ আমানত সেতু। এ সেতুর তুলনায় কর্ণফুলী টানেলের টোল হার যানবাহন ভেদে আড়াই থেকে ছয় গুণ পর্যন্ত বেশি। টোল হারের এ পার্থক্য টানেলে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।’

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘বন্দর নগরী ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করতে এই একটি টানেল কতটা দরকার ছিল, তা নিয়ে নীতিনির্ধারকরা সঠিকভাবে পর্যালোচনা করেননি। যেহেতু প্রকল্পের ব্যয় বেশি, তাই এখান থেকে কোনোদিন প্রত্যাশিত আয় হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।’

টানেলের উপ-প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, ‘টানেল একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটিকে লোকসানি প্রকল্প বলা যাবে না।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাগরে জলদস্যুর গুলিতে ট্রলারের মাঝি নিহত, নিখোঁজ একাধিক জেলে
পরবর্তী নিবন্ধউখিয়ায় চার ব্যবসায়ীকে অর্থদণ্ড, পলিথিন জব্দ