চৌধুরী হারুনুর রশিদের সারাজীবনের আকাঙ্ক্ষা ও দেশের বিদ্যমান শ্রম অবস্থা

তপন দত্ত | বৃহস্পতিবার , ৭ নভেম্বর, ২০২৪ at ৮:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের প্রয়াত শ্রমিক নেতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব চৌধুরী হারুনুর রশিদ ২০০০ সালের ১৯ অক্টোবর প্রয়াত হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি ছিলেন দেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টি.ইউ.সি)’র সভাপতি। ১৯৭২ সালের আনুষ্ঠানিকভাবে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলন তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আমল থেকে তিনি রাজনৈতিক ও শ্রমিক আন্দোলন যুক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম ভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তিনি প্রথম ৪ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন এবং ১২ বছর আত্মগোপনে থেকে চট্টগ্রামে ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান’ ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে এবং শ্রমিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শ্রমিক শ্রেণির শোষণ মুক্তির আন্দোলন ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ১৯৫২ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার হয়ে একনাগাড়ে ৪ বছর জেল খাটেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন শ্রমজীবী মানুষের কিছু অর্থনৈতিক দাবী, মজুরী বৃদ্ধি করলেই সম্পদ উৎপাদনকারী শ্রমজীবী মানুষের সমস্যার সমাধন হবে না এবং তাদের ট্রেড ইউনিয়নে সংগঠিত হওয়া, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন ও গণতান্ত্রিকভাবে নেতৃত্ব নির্বাচনের অধিকার, পরিবার নিয়ে জীবনধারণের মজুরী, সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা, উৎসব ভাতা ইত্যাদি অধিকার সম্বলিত গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন করতে হবে। শ্রম আইন প্রণয়নে যথাযথ ভূমিকা থাকতে হবে শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিদের।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে প্রথম শ্রমমন্ত্রী ছিলেন চট্টগ্রামের আর একজন শ্রমিক ত্যাগী নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী। তখন পর্যন্ত পাকিস্তান আমলে প্রণীত ১৯৬৯ এর শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ দ্বারা ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার বহাল ছিল। এছাড়া ১৯৬৫ সালের আইন ফ্যাক্টরী এ্যাক্ট, শপ্‌স এন্ড এস্টাবিলিশমেন্ট এ্যাক্ট ১৯৩৬ সালে প্রণীত আইন স্বাধীন বাংলাদেশে বহাল ছিল। টি ইউ সি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ৩ দিন ব্যাপী ১ম জাতীয় সম্মেলনে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে দাবী উঠালেন ‘ঔপনিবেশিক ও পরাধীন আমালের শ্রম আইন দিয়ে স্বাধীন দেশের শ্রম ব্যবস্থাপনা ও শিল্প সম্পর্ক নির্ধারণ করা সম্ভব নয়’। সেই সম্মেলনে তিনি একটি সমন্বিত খসড়া শ্রম আইন প্রণয়নের জন্য প্রস্তাব রাখেন। তিনি আরও বলেন ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ৮৬% শিল্পগুলি লাভজনকভাবে পরিচালনা করতে হলে মেহনতি মানুষকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ না রেখে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তাদের অংশগ্রহণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রভুভৃত্য সম্পর্কের অবসানের দর্শন সম্বলিত আইন প্রণয়ন করতে হবে। সাথে রাষ্টায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সমূহকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার দায়ভার শ্রমিকদেরও নিতে হবে। অনিয়ম দুর্নীতি চলবে না। শ্রমিকদের কাজে ফাঁকি দেওয়া চলবে না। শ্রমিক নেতৃত্বকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে। রাষ্ট্রের সংবিধান ও রচনা করতে হবে উৎপাদকারী শ্রমিক কৃষক মেহনতী মানুষদের স্বার্থ রক্ষা করে।

চৌধুরী হারুনের প্রস্তাব অনুযায়ী খসড়া শ্রম আইন প্রণয়নের জন্য তাঁকে চেয়ারম্যান করে শ্রম আইনে অভিজ্ঞ ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়। আইন সম্পর্কে পরামর্শ নেওয়ার জন্য কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ও শ্রম আইন বিশেজ্ঞদের সাথে আলোচনা করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়যারা টিইউসির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নন।

টিইউসি প্রস্তাবিত খসড়াটি তিনিও চট্টগ্রামের আহসান উল্লাহ চৌধুরী শ্রম মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরীর নিকট হস্তান্তর করেন। তার ২ জনেই বঙ্গবন্ধুর সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করতে জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীকে অনুরোধ জানান।

আমি তখন শ্রমিক আন্দোলনে নবীন। ১৯৭০ সালে ছাত্র জীবন শেষ করার পর পার্টির পরামর্শে সরকারি চাকরি ছেড়ে চা শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য ফটিকছড়ি যাতায়াত শুরু করি। চৌধুরী হারুন তখন হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে। আবু তাহের মাসুদ, খোরশেদুল ইসলামও শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন। আবু তাহের মাসুদ চন্দ্রঘোনা রাঙ্গুনিয়া শিল্পাঞ্চলে, খোরশেদুল ইসলাম কালুরঘাট শিল্প এলাকায় পাটকল শ্রমিকদের সাথে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। আগে থেকে বন্দরে আহসানুল্লাহ চৌধুরী, রেলে এমএস হক কাজ করতেন। শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন আন্দোলনের অস্তিত্ব ছিল রেলে ও বন্দরে। আমাদের সকলের নেতা ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশিদ। তিনি সংগঠন ও আন্দোলনের কৌশল গ্রহণ করে প্রকাশ্য নেতৃত্বকে জানিয়ে দিতেন। তখন চা শ্রমিকদের জন্য ১৯৬২ সালের ‘প্লান্টেশন অর্ডিন্যান্স এ্যাক্ট’ নামে একটি বিধিমালা জারি ছিল। ঐ বিধিমালা এমনভাবে প্রণীত ছিল কার্যত সবকিছু মালিকদের ইচ্ছানুযায়ী হতচিকিৎসা, বাসস্থান, রেশন ইত্যাদি। যখন তারা ইচ্ছা করবে তখন দেবে। চা বাগান মালিকরা অধিকাংশই ছিল পাকিস্তানি, বিট্রিশ। চা শ্রমিকদের জন্য প্রণীত বিধিমালায় ছিল প্রচুর অসঙ্গতি ও শ্রমিক ঠকানোর কৌশল। আমি বিষয়টি চৌধুরী হারুনকে জানালে তিনি আমাকে নিয়ে একদিন সচিবালয়ে শ্রমমন্ত্রী জহুর আহম্মদ চৌধুরীর সাথে দেখা করেন। জহুর আহম্মদ চৌধুরী শ্রম সচিব লেবার ডাইরেক্টর সহ অন্য কর্মকর্তাদের নিয়ে আমাদের সাথে প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনা করলেন চা শ্রমিক বিধিমালা ও শ্রম আইন নিয়ে। এইসব বিষয়ে তিনি অফিসারদের নোট নিতে বললেন। পরে তিনি শ্রম আইন প্রণয়ন ও সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করবেন বলে জানিয়ে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত কয়েকমাস পরে শ্রমমন্ত্রীর মৃত্যু হলে সেই কমিশন আর গঠন করা হয়ে ওঠেনি। পরে বঙ্গবন্ধুও নিহত হলেন।

১৯৭৬ সালে শিল্প সম্পর্ক অধ্যাদেশ স্থগিত করে অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে শ্রমিকদের ইউনিয়নের পছন্দমত নেতৃত্ব নির্বাচনের অধিকার খর্ব করা হয়। এইটা ছিল আইএলও কনভেনশন ৮৭ এর একটি মৌলিক বিচ্যুতি। তারই ধারাবাহিকতা ক্রমান্বয়ে ২০০৬ সালে অক্টোবরে একটি সমন্বিত শ্রম আইন সংসদে পাশ করা হয়। শ্রমিকের সংগঠন করার অধিকার ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হতে থাকে। রাষ্ট্রয়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করে নব্য পুঁিজর মালিকদের দিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৩ সাল ও ২০১৮ সালের সংশোধনে এবং সর্বশেষ জরুরি সেবার নামে ঘুরিয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার খর্ব করার প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করা হয়। ২০২৩ সালে অবশ্য সারা দেশব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেই আইন নিয়ে সরকার আর অগ্রসর হয়নি। অভিজ্ঞতায় দেখি যে শ্রমজীবী মানুষ দাঁড়িয়ে গেলে লুটেরা পুঁজির তল্পিবাহকরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

বিগত ১৫ বছর বাংলাদেশে পুঁজি লুণ্ঠনের মচ্ছব চলেছে, এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ৭৬ সাল থেকে। সেই থেকে বহু দলের, ধরনের সামরিক বেসমারিক সরকার দেশ শাসন করেছে। কম বেশি সবাই ব্যাক্তিমালিকদের ব্যাংক লুট, টাকা পাচারের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে। তবে বিগত ১৫ বছরে প্রক্রিয়া ঝড়ের গতিতে অগ্রসর হয়েছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এখন বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই ৭ কোটি ৩৫ লক্ষ (বিএসএস জরিপ)। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু কৃষক শ্রমিক শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি হয়নি। অথচ শিল্পখাত, সেবাখাত, সার্ভিস সেক্টরে কর্মরত বিপুল সংখ্যাক শ্রমজীবী মানুষ তাদের শ্রমে ঘামে উৎপাদন চালু রেখে দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। বিদেশে এক কোটির বেশি মানুষ হাড়ভাঙা খাটুনী খেটে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখে। সেই টাকা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লুটেরারা পাচার করে। আর শ্রম আইনে শ্রমিকের অধিকার ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করা হচ্ছে। লুটেরা পুজির মালিকরা তাদের পুজির স্বার্থের পাহারা জারি রাখার জন্য যেমন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে তেমনি প্রশাসন ব্যবহার করে একদল তথাকথিত শ্রমিকনেতা তৈরী করে যারা শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের প্রতি আস্থাশীল নয়।

সারা বিশ্বে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আর কর্পোরেট পুঁজির একাধিপত্য চলছে। কর্পোরেট পুঁজি রোবোটিঙ উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করছে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশ ও অনুন্নত দেশেও শ্রমজীবী মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। এই অবস্থায় স্রোতে গা না ভাসিয়ে আমাদের ভাবতে হবে কোন পদ্ধতিতে পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের শ্রমজীবী মানুষকে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়। দেশপ্রেমিক শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে বিশ্বস্ত শ্রমিক সংগঠন ছাড়া মেহনতি মানুষের অধিকার রক্ষা করা যেমন সম্ভব নয় তেমনি আইএলও কনভেনশন ৮৭/৯৮ অনুযায়ী শ্রমিকের পছন্দমত নেতৃত্ব নির্বাচন ও দর কষাকষির অধিকারসহ গণতান্ত্রিক শ্রম আইনের অস্তিত্ব ছাড়া শ্রম অধিকার রক্ষা করা সম্ভব নয়। টিইউসির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি চৌধুরী হারুনুর রশিদের সারাজীবনের আকাঙ্ক্ষা ছিল দেশে উৎপাদিকা শক্তির অধিকার রক্ষা, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন ও শিল্পনীতি প্রণয়ন।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম জেলা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউকিল মুন্সী : একজন বিরহী বাউল
পরবর্তী নিবন্ধছৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছাদেক মুছা