ছাপাখানাগুলো : কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস

স্মৃতির শহর চট্টগ্রাম

কুমার প্রীতীশ বল | বুধবার , ৬ নভেম্বর, ২০২৪ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

একটা সময় ছিল, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যখন ব্যবসা বাণিজ্য করে উচ্চবিত্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখত, তখন মুদ্রণ ব্যবসায় যুক্ত হতো। আমাদের সময়কালেও প্রেস ব্যবসাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ব্যবসা হিসেবে দেখা হতো। এমন মতটি আমি জেনেছিলাম, আমার কাকা অধ্যাপক সরোজ বলের কাছ থেকে। ছাত্রাবস্থায় আমি তাঁর সঙ্গে গত শতকের আশির দশকে প্রথম ছাপাখানায় গিয়েছিলাম। প্রেসটির নাম ছিল শান্তি প্রেস। টেরীবাজার কাটাপাহাড়ে ছিল প্রেসটি। পাশে আরেকটি প্রেস ছিল, ওটার নাম চন্দ্রনাথ প্রেস। টেরীবাজার কাটাপাহাড় তখন প্রেসপাড়া নামে খ্যাত ছিল। তিনিই আমাকে ওখানে বসে প্রুফ কী করে দেখতে হয়, তা শিখিয়েছিলেন। পুরো ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকে। ছাপাখানাগুলো কেমন যেন অন্ধকার ভুতুড়ে ধরনের ছিল। এ কারণে কিনা জানি না, তখন একটা কথা প্রচলন ছিল, ছাপার পরে কোনো ধরনের ভুল পেলে বলা হতো, ছাপাখানার ভূত। নির্ভুল বানানে তখন কোনো পাওয়া একবারেই মুশকিল ব্যাপার ছিল।

শান্তি প্রেসের ভেতরে ঢুকে দেখলাম, কয়েকজন বুড়ো ভদ্রলোক গায়ে হাতওয়ালা সাদা গেঞ্জি হাতে কালিঝুলি মাখা, চোখে মোটা পুরো ফ্রেমের চশমা ছোট একটি টুলে বসে তার গা ঘেঁষে সামনে, ডানপাশে, বামপাশে ছোট ছোট অনেক খোপ। সেসব খোপে সিসা দিয়ে বানানো উল্টো করে তৈরি ইংরেজি বা বাংলা বর্ণ, চিহ্ন আছে। একেকটি খোপে একেক ধরনের বর্ণ বা চিহ্ন আছে। টুলে বসা পথের পাঁচালী সিনেমার সেই ইন্দিরা ঠাকুরের মতো বুড়োমানুষগুলো হাতে আরেকটা ছোট্ট ট্রেতে সামনেডানবামের খোপ থেকে সীসার বাংলা বা ইংরেজি হরফ, চিহ্ন নিয়ে একটার পাশে বসিয়ে শব্দ, বাক্য তৈরি করছেন। আমি ভেবে পাই না কী করে মনে রাখেন কোন গর্তে কোন বর্ণ বা চিহ্ন আছে। এ মানুষগুলোকে কম্পোজিটার বলা হতো। সব সময় তাঁরা নীরবে দেখে দেখে করছেন তা কিন্তু না, অনেক সময় কথা বলতে বলতেও টাইপের কাজটা করেন। কী আশ্চর্য তাদের স্মরণশক্তি। এভাবে অনেক বাক্য দিয়ে একটি লেখা তৈরি করে ‘গ্যালি’ নামের একটি কাঠের পাত্রে বর্ণগুলো রাখে। ‘গ্যালি’তে রাখা সেসব উল্টো বর্ণের গায়ে রোলার দিয়ে কালি লাগানো হয়। কালিমাখা সেসব বর্ণের ওপর বিশেষ একটি পদ্ধতিতে নিউজ প্রিন্টের একটি কাগজ চাপ দেওয়া হয়। তখন সেই নিউজ প্রিন্টের কাগজে বর্ণগুলো ফুটে ওঠে। সে কাগজে প্রুফ রিড করে বানান ঠিক হয়েছে কি না দেখা হয়। ছাপা কাজে ভুল হলে ভুল বর্ণ সরিয়ে সঠিক বর্ণ বসায়। প্রুফ দেখার পর গ্যালিতে সাজানো বর্ণ মেশিনে সেট করে কাগজে ছাপানো হতো। বর্ণ বা লেটার বসিয়ে ছাপার কাজ হতো। এভাবেই কাজ হতো লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনে।

গ্রুফ দেখার কাজটা সেই ছাত্রাবস্থায় কাটাপাহাড় শান্তি প্রেসে শিখেছিলাম আমার কাকা অধ্যাপক সরোজ কুমার বলের কাছে। শান্তি প্রেসের মালিক অশোক চৌধুরীও আমাকে এব্যাপারে তখন সহায়তা করতেন। বান্ধব পাঠাগারের বার্ষিক স্মারকটা শান্তি প্রেস থেকে প্রকাশিত হতো। অধ্যাপক সরোজ কুমার বল ছিলেন বোধনএর সম্পাদক। ফলে আমি খুব কাছে থেকে তখন কাজগুলো দেখেছি।

তখন আরেক ধরনের প্রেস ছিল ওটার নাম ছিল অফসেট প্রেস। গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে শান্তি প্রেসে লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনে মুদ্রণের কাজ দেখা শুরু করেছিলাম, এখনও আমার নিয়মিত ছাপাখানার যোগাযোগ আছে। এখনও আমি প্রেস ভিজিটে যাই। কিন্তু সেদিনের মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে বর্তমানের কোনো মিল খুঁজে পাই না। তখনকার ছাপাখানাগুলো আজকালকার প্রেসের মতো ঝকঝকে তকতকে ছিল না। ভেতরদিকটায় ছিল আলোকস্বল্পতা আর ধূলিকালিময়, স্যাঁতস্যাঁতে একটা ভুতুরে পরিবেশ। একারণে তখন মুদ্রিত উপকরণে কোনো ভুল পাওয়া গেলে বলা হতো ছাপাখানার ভূত। এই ছাপাখানার ভূত নিয়ে তখন প্রবীণদের মুখে অনেক গল্প শুনেছি। লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনে ছবি ছাপাতে হলে অনেক প্রসেস অনুসরণ করতে হতো। ছবির একটা কাঠের ব্লক তৈরি করা হতো। তারপর ঐ ব্লক কম্পোজিটারের কম্পোজকৃত লেখা মিলিয়ে ছাপার কাজ সম্পন্ন করা হতো। ছাপাখানার ভূতের মতো এই ব্লক নিয়েও অনেক গল্পের প্রচলন ছিল। ২৫ শে বৈশাখ নাকি ২২ শ্রাবণে রবীন্দ্রনাথের ছবির ব্লকের পরিবর্তে শহীদুল্লাহর ছবির ব্লক বসিয়ে দিয়েছিল কোনো এক পত্রিকা। দু’জনের দাড়ি ছিল বলে প্রবীণ কম্পোজিটার এ ভুল করেছিলেন।

চট্টগ্রামে প্রথম ছাপাখানার আবির্ভাব ঘটে আজ থেকে প্রায় ১৪২ বছর আগে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভাকর পত্রিকার সম্পাদক শরচ্চন্দ্র দাশ ও তাঁর ভাই নবীনচন্দ্র দাশ চট্টগ্রামের জয়নগরে (জয়নগরের তখনকার নাম ছিল ভাঙঘুটনা) জনাব বসির উল্লাহ চৌধুরীর বাড়িতে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা। উল্লেখ্য যে, এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম পাক্ষিক সংশোধনী। সংশোধনী পাক্ষিক পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কাশীশ্বর গুপ্ত। প্রেসটির নাম ছিল শারদ যন্ত্র্‌। পরে মালিকানা পরিবর্তন হলে শারদ যন্ত্রের নাম অন্নদা প্রেস হয়, আরও পরে হয় গোবিন্দ প্রেস। কুড়ি শতকের প্রথমভাগে চন্দ্রশেখর প্রেস, সাধারণ প্রেস, সংশোধনী প্রেস, সনাতন প্রেস, চট্টেশ্বরী প্রেস, কোহিনূর প্রেস, মিন্টো প্রেস, হার্ডিঞ্জ প্রেস, পাঞ্চজন্য প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। এর কিছুদিন পরে সুনীতি প্রেস, মডার্ণ প্রিন্ট্রিং কোং লি., দীন প্রেস, দি আর্ট প্রেস, ইসলামাবাদ প্রেস, আমির প্রেস, কারোনেশন প্রেস, আলাবিয়া প্রেস, চিটাগাং প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং কোং, ইম্পেরিয়াল প্রিন্টিং প্রেস, প্রবর্তক প্রেস ও বেঙ্গল প্রিন্টিং ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠিত হয়। পাঞ্চজন্য প্রেস থেকে প্রকাশিত পত্রিকা পাঞ্চজন্য চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ও অসহযোগ আন্দোলনের খবরাখবর খুব গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হতো। পাঞ্চজন্য পত্রিকাকে বিপ্লবীদের মুখপত্র হিসেবে বলা হতো। সুনীতি প্রেস থেকে প্রকাশিত হতো পাক্ষিক সুনীতি। এর সম্পাদক ছিলেন খান বাহাদুর আমন আলী। দৈনিক আজাদীর ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ সংকলনে উল্লেখিত ছাপাখানাগুলো ব্রিটিশ পরবর্তী সময়ে ব্যতীত অধিকাংশ বন্ধ হয়ে যায়। ‘দি আর্ট প্রেস’ শত বছরের স্মারক হিসেবে এখনও সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ‘বইঘর’র মালিক সৈয়দ মোহাম্মদ শফির দাদা নুরুল আলম কোম্পানি ১৯২৬ সালে ‘ দি আর্ট প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে নুরুল আলম কোম্পানি’র চতুর্থ জেনারেশন সৈয়দ মোহাম্মদ শফির পুত্র তা পরিচালনা করছেন।

পাকিস্তান আমলে অনেক ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রামে, এরও অনেক স্বাধীন বাংলাদেশে অব্যাহত ছিল। পাকিস্তান আমলে শহীদজায়া মুশতারী শফির প্রতিষ্ঠিত নারীদের পরিচালিত বান্ধবী নামে একটি প্রেস ছিল শুনেছিলাম। স্বাধীনতা সংগ্রামে সেটি জ্বালিয়ে দিলে আর তা শুরু করা সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রামের বেশিরভাগ ছাপাখানা আন্দরকিল্লা, মোমিন রোড, সিরাজদৌল্লাহ রোডে সীমাবদ্ধ ছিল। পাকিস্তান আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানাগুলোর অন্যতম হলো: কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস, ইসলামিয়া লিথো অ্যান্ড প্রিন্টিং প্রেস, ক্রিসেন্ট প্রেস, সিগনেট প্রেস, চন্দ্রনাথ প্রেস, আজাদী প্রিন্টার্স, মডার্ন প্রেস, সাইমোগ্রাফিকস, নিবেদন প্রেস, সুরমা প্রিন্টার্স, কোডেক প্রেস, ক্রিডেন্স প্রেস, আকাবা প্রিন্ট্রাস, সোনালী প্রিন্টার্স, ইডেন প্রেস, চেম্বার প্রেস, ওরিয়েন্ট কালার, লিনিট, নিও কনসেপ্ট, অগ্রণী প্রিন্টার্স, বাংলাদেশ প্রিন্টার্স, বর্ণরেখা, সীমান্ত, গুডেনবার্গ। সব নাম এখন আর স্মরণে আনতে পারছি না।

সাহিত্যসংস্কৃতি এমন কী রাজনৈতিক চর্চা ও আন্দোলনের সঙ্গে ছাপাখানাগুলোর একটা সংযোগ ছিল। তখন কারা কোন প্রেসে কাজ করে তাও আমাদের জানা ছিল। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ ছাপা হয়। দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কবিতাটি গোপনে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে রাত জেগে ছাপিয়ে সেদিন জনগণের ক্ষোভের বাস্তব রূপ দেন। পাকিস্তান সরকার পুস্তিকাটি নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস বন্ধ করার আদেশ দেয়। ম্যানেজার দবির উদ্দিন আহমদ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। বাংলাদেশের ছাপাখানার ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক হিসেবে রয়ে গেল।

ছাপাখানার সঙ্গে যখন কম্পিউটার এসে যুক্ত হলো, তখন লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনের যুগের অবসান ঘটে। শুরুর দিকে কম্পোজের কাজটা হতো এ্যাপেল মেকেন্টোজ কম্পিউটারে। বাংলাদেশে এর আবির্ভাব ঘটে মোস্তফা জব্বারের মাধ্যমে। তখন কম্পিউটার রুমে প্রবেশ করতে হতো খালি পায়ে। তখন থেকে কম্পোজ আর মুদ্রণ পৃথক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তখন এ্যাপেল মেকেন্টোজ কম্পিউটার কিনলে দু’জনকে ফ্রি প্রশিক্ষণ দিতেন মোস্তফা জব্বারের আনন্দ প্রিন্টার্স। নন্দন প্রতিষ্ঠিত হলে আমি নন্দনের পক্ষ থেকে কিছুদিন ফ্রি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। এখন ছাপাখানার আধুনিকায়ন হয়েছে, কিন্তু সেই আবেগ আর নেই। সেই আবেগ আর ভালোবাসার প্রকাশ আমরা অনুভব করতে পারি কবি মিনার মনসুরের ‘চলে যাব’ কবিতায়। চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি নিবেদন প্রেসের কালিঝুলিকেও বিদায় জানিয়েছিলেন। গতশতকে ছাপাখানাগুলো এভাবেই ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছিল প্রিয়জনদের।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ