বাংলাদেশের শিক্ষাজগতে মেঘের ঘনঘটা সর্বদা বিরাজমান। টেকসই শিক্ষা কারিকুলাম এর অভাব সেই ৭১ এর স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে চলমান। দেশের মধ্যকার কোনো সরকারই শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, এবং যুগপোযোগী শিক্ষাক্রম চালু কর েসমর্থ হয় নি। যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তখনই তারা নিজেদের সুবিধা মাথায় রেখে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করেছে। সরকার পরিবর্তিত হলেই সব কিছুর সাথে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটে যায়, বেড়ে যায় দলীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা। মাঝখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্টজনেরা পড়ে যায় বেকায়দায়, ঘটে ধারাবাহিক বিপর্যয়। এসব কারণে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার পরিকাঠামোগত উন্নয়ন আমাদের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এখন কঠিন বাস্তবতা বলে মনে হয়।
বিশ্বায়নের এই যুগে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এর প্রসারণ ঘটে চলেছে, সেখানে শিক্ষার মান উন্নয়ন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে বৈশ্বিক নাগরিক হয়ে গড়ে উঠে বৈশ্বিক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। কিন্তু সেক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পোঁছাতে শিক্ষার মান অন্তরায় হয়ে পড়ছে। বৈশ্বিক শিক্ষার্থীদের সাথে তাল মেলাতে যে শিক্ষাক্রম তৈরি করা প্রয়োজন, তা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমান এআই প্রসারণ যুগে মানসম্মত শিক্ষা অপরিহার্য। এসডিজি উন্নয়ন এর চার নম্বর লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে নির্ধারিত রয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যেন মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের যোগ্য হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এ ক্ষেত্রে যেন অন্তরায় না হয় সেটাই সংশ্লিষ্ট জনদের পরিকল্পনায় থাকুক, এটাই কাম্য।
যেহেতু এখন দলীয় সরকার নেই, তাই অন্তর্র্বর্তী সরকার আন্তরিক হলে নানা সংস্কারের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও সংস্কারের মাধ্যমে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন এর সৃষ্টি করে শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। যদি শিক্ষা উপদেষ্টা আন্তরিক ভাবে নিমগ্ন হয়ে এ কাজের সমাধান করেন এভাবে, যেন কোনো সরকার কোনো দিনও পরিবর্তন করতে না পারে, এমন শিক্ষাক্রমের জন্য জাতি উন্মুখ হয়ে আপেক্ষায় আছে।
নতুন বাংলাদেশের এই যাত্রায় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার অতীব জরুরি। জুলাই বিপ্লবের ফলে যেমন করে পুলিশের মনোবলে আঘাত হেনেছে, তেমন করে যে কোনো কারণেই হোক প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নানা বাধার চ্যালেঞ্জ পার করে এগোতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পড়ার মানও তলানিতে। শিক্ষার্থীরা এখন ক্রমে ক্রমে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বেপরোয়া হয়ে উঠার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো, গত এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের আচরণের ক্ষেত্রে। কবে, কোথায় কে শোনেছে! অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীরা কৃতকার্য হওয়ার জন্য শিক্ষাবোর্ড ঘেরাও করে? এমন কি সচিবালয় এর মতো জায়গায় গিয়ে আন্দোলন করে! যত কারণই থাকুক না কেন; অন্তত অকৃতকার্যতার লজ্জায় শিক্ষার্থী মুখ লুকিয়েই থাকবে, এটাই তো হওয়ার কথা, কিন্তু তা না, আন্দোলন করেই পাশ ছিনিয়ে আনতে হবে, এটাই যেন রেওয়াজ। এসব সমাজের শিক্ষার্থীদের এক বেপরোয়া আচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে।
শিক্ষা তো মানুষকে সভ্য করার জন্য, নিজেকে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য, শিক্ষা গ্রহণে মানুষ আলোকিত হয়ে উঠে। কিন্তু এখন শিক্ষা উল্টো চালে চলছে। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের গলায় জুতোর মালা থেকে আরম্ভ করে মারধর, গাছের সাথে বেঁধে রাখা, জোর করে পদত্যাগ পত্রে সাইন নেওয়া, আরো কত কী। হ্যাঁ মানলাম তাঁরা পতিত সরকারের চাটুকার, ক্ষমতালোভী, দুর্নীতিবাজ। কিন্তু এই চাটুকার, লোভী, দুর্নীতিবাজ শিক্ষকদের জন্য প্রশাসন তো রয়েছে। সন্তান সম শিক্ষার্থীদের এহেন আচরণ কোনো ভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রশাসনের একটি অব্যাহতি পত্রই এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে, যা এখন কার্যকর হচ্ছে। আসলে মূল্যবোধ হীন, মানহীন শিক্ষা সমাজকে ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে একেবারে তলানিতে পৌঁছে গিয়েছে। পরিসংখ্যানে এগিয়ে থাকা সনদ নির্ভর শিক্ষার্থীদের মানহীন শিক্ষার প্রসারণে আজ সমাজের শিক্ষাক্ষেত্রের এই ক্রমাবনতি।
গত সরকারের নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল হওয়ায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। তাই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সমর্থনকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার মানের সংস্কার ও গুণগত পরিবর্তন এর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রত্যাশা পুরো জাতির।
নতুন শিক্ষা কারিকুলাম ইতিমধ্যে বন্ধ করলো অন্তর্র্বর্তী সরকার, কিছু সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে জারী হয়েছে। নবম–দশম শ্রেণিতে আবার বিভাগ বিভাজন চালু করা হবে। মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষা কারিকুলামকে যুগোপযোগী না করলেও শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। চারদিকের বিশৃঙ্খলার মধ্যে শিক্ষা উপদেষ্টাকে এগোতে হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্যবই এ পরিবর্তন আনার বিধি নিয়ে কাজ করে চলেছেন।
যেহেতু জানুয়ারি সন্নিকট, তাই বই উৎসবও সন্নিকট, নতুন সরকারের হাতে সময়ও খুব কম। জানুয়ারির বই উৎসবকে সফল করার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় পরিমার্জন সহ দ্রুত বই ছাপানোর কাজে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বর্তমানে চালু থাকা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়,ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এনসিটিবি এর সূত্র মতে চলমান কার্যক্রমে সক্রিয় শিখন প্রক্রিয়া থাকায় আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পরিমার্জিত বিষয় নিয়ে পাঠ্যবই প্রদান করা হবে। কিন্তু চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণির পাঠ্যবই নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তে সৃজনশীল শিক্ষাক্রম যেটি ২০১১ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত চালু ছিল, সেই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যবই তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। উক্ত শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই সমূহের কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিমার্জন করে বই ছাপানোর নির্দেশ হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এবারের পরিমার্জিত পাঠ্যবিষয়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে পাঠ্যবই এর প্রতিটি অধ্যায় এর শেষে অনুশীলনী যুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
পরিমার্জন এর ক্ষেত্রে ২০২৪ সালের জুলাই এর গণ অভ্যুত্থান এর চেতনার প্রতিফলনই গুরুত্ব পাবে। আর স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর ছবির স্থানে অভ্যুত্থান বিষয়ক গ্রাফিতি বা দেওয়ালে আঁকা দৃশ্যের ছবি যুক্ত করা হবে। প্রথম আলোর সম্পাদকীয় কলামের তথ্য মতে পরিমার্জনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পাঠ্যপুস্তকে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের চেতনার যুক্ত হওয়ার নির্দেশনা থাকলেও যেহেতু এই অভ্যুত্থানের বিষয়টি অতি নিকট ইতিহাস এবং এবার সময়ও কম তাই লেখা হিসেবে না রেখে কিছু পাঠ্যপুস্তকে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান এর গ্রাফিতি এবং দেওয়াল দৃশ্য স্থান দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের যেসব বই নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে যাবে, সেখানে ‘অতিরিক্ত’ ঐতিহাসিক তথ্য বা কোনো ব্যক্তির ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রশংসা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর সরকার শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিনেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দিয়ে আসছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ বছর বই উৎসব চ্যালেঞ্জ এর জায়গায় রয়েছে। এনসিটিবির তথ্য সূত্র মতে, গত বছর চলমান শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩১ কোটি পাঠ্যবই ছাপানো হয়েছিল। এবছর যেহেতু নবম–দশম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন চালু করা হবে, এবং ২০১২ সালের শিক্ষা কারিকুলাম অনুযায়ী বই ছাপানো হবে তাই, ২০২৫ সালের জন্য পাঠ্যবই ছাপাতে হবে প্রায় ৪০ কোটি। স্বল্প সময়ের মধ্যে বই ছাপানোর কাজ কঠিনতম চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে এবার যেহেতু দেশের অভ্যন্তরে পাঠ্যবই প্রস্তুতকরণের প্রক্রিয়া চলমান, তাই ধারণা করা যায় তাদের কাছ থেকে দ্রুত কাজ আদায় করে নেওয়ার জন্য সচেষ্ট থাকবে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ। এনসিটিবি এর চেয়ারম্যান মহোদয় বই উৎসব চ্যালেঞ্জ হলেও যথাসময়ে বই বিতরণ করা হবে বলে সাংবাদিকদের কাছে মত বিনিময় করেছেন। শিক্ষা, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যবই, পরিমার্জিত বিষয়, জুলাই অভ্যুত্থান এবং বই উৎসব সব মিলিয়ে ২০২৫ সাল শিক্ষক শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সর্বক্ষেত্রে আনন্দময় হয়ে উঠুক এটাই জাতির কাম্য।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, হুলাইন সালেহ নূর কলেজ।