(প্রথম পর্ব)
বাইরে ছাইরঙা বিকেল। কম্বলের ভেতর থেকে শুধু মাথাটা বের করে জানালার দিকে তাকালাম। আকাশে মেঘ আছে কিনা বুঝলাম না। সস্তা হোটেল, রুম হিটারের ব্যবস্থা নেই। তাই শার্শি বন্ধ থাকলেও এমন শীত করছে যে মনে হচ্ছে প্রবল জ্বর এসেছে বুঝি! একেবারেই ভালো লাগছে না। গ্যাংটক যেতে না পারার দুঃখটা ক্ষণে ক্ষণে বুকে মোচড় দিচ্ছে।
ধীরে ধীরে বাইরের ছাইরঙা বিকেলটা মরে পোড়া কয়লার মতো হয়ে এলে, ভেতরের বিরক্তি আর গোপন অবসাদ নিয়ে বিছানা ছাড়লাম। ঘটি অর্থাৎ কলকাতার আদিবাসিন্দা জানা–বাবুর হোটেলে উঠেছি আজ দুপুরেই। শিলিগুঁড়ি থেকে যে জিপে দার্জিলিং এসেছি তারই ড্রাইভার শচিন এই হোটেলের সন্ধান দিয়েছে। বিনিময়ে অবশ্য আমার কাছ থেকে না হলেও জানা–বাবুর কাছ থেকে রোজগার করেছে নগদ ত্রিশ রুপি। দার্জিলি; দার্জিলিংই বা বলি কেন, আমার দেখা সব ট্যুরিস্ট প্লেসেই টাকা ছাড়া ফ্রি সার্ভিস নেই। গিজার আগেই চালানো ছিল, উত্তপ্ত জলে স্নান সেরে ভারি জামা কাপড় চাপিয়ে বাইরে বেরুলাম।
ম্যাল এ রোদ পড়ে এসেছে। লোকজনের মধ্যে বেশ কয়েকজন বাঙালি চেহারার যুবতিকে দেখতে পেলাম। ভারী পোশাকের আড়ালে তাদের যৌবনোচিত ঢেউগুলো ঢাকা পড়ায় তাদের এখন হোল্ডঅলে বাঁধা বস্তার মতোই দেখাচ্ছে। তবে নারীদের শুধু মুখশ্রীর প্রতিই আমার আকর্ষণ বেশি। একটা আধভেজা ঠাণ্ডা বেঞ্চে বসে সিগারেট ধরালাম। যা ঠাণ্ডা পড়েছে তাতে এই মুহূর্তে খানিকটা ব্র্যান্ডি পেলে ভালো লাগতো; কিন্তু সূর্যাস্তের ঠিক এই মুহূর্তটাতে লিকার শপে ঢুকতে ইচ্ছে হলো না।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। লাল আকাশটার কোনো একদিকে সূর্য! এই সময় সূর্যের রশ্মিগুলো আলাদাভাবে দেখতে পাওয়া যায়। একটু কল্পনা করলাম–সন্ধ্যা বেলার সূর্য থেকে অসংখ্য লাল রঙের স্বপ্ন পৃথিবীতে ঝরে পড়ছে মনে হলো…
প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বেশিক্ষণ বসা গেল না। শচিনের নির্দেশিত পথে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় ঠিকই খুঁজে নিলাম শিরিং এয়ামোদের উডেন হোম কাম রেস্টুরেন্ট। বিশ বছর বয়সী সুন্দরী নেপালি যুবতি শিরিং শিলিগুঁড়ির এক নার্সিং হোমের ছাত্রী, শচিনের কাজিন। যে ক’দিন দার্জিলিং আছি এখানেই সস্তায় দু’বেলা খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। নেপালি এই পরিবার গত বিশ বছর যাবত দার্জিলিংয়ের বাসিন্দা। শিরিংয়ের মা যথারীতি হাউজ ওয়াইফ, বাবা জিপ ড্রাইভার, বড় বোনের বিয়ে হলেও ছেলেপুলেসহ সে এখন বাপের বাড়িতেই। আধ কাঠারও কম এক টুকরো জমির ওপর কাঠের নির্মিত ডুপ্লেক্স বাড়িটাই এদের বাসস্থান ও অর্থ উপার্জন কেন্দ্র। ভর সন্ধ্যাবেলাতেই ডিনার সারলাম প্রচণ্ড ঝাল দেয়া চিকেন ও চীনে মূলার সালাদ দিয়ে। অ্যাডভান্স দেয়া ছিল, খাওয়া শেষে শিরিংয়ের বড় বোন ডেজার্ট হিসেবে নিয়ে এলো ছোট্ট গ্লাস ভর্তি ঘরে তৈরি ওয়াইন। আমার ইতস্ততঃ ভাব দেখে হিন্দি ভাষায় সে যা বোঝালো বাংলা তর্জমা করলে তার অর্থ দাঁড়ায়: ‘ইহা পান করিলে খাদ্য ভালো হজম হইবে, শরীরের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাইবে, প্রাতঃকৃত্যে স্বস্তি লাভ করা যাইবে . . .’
এত গুণাবলী বিশিষ্ট তরল পান না করে পারা যায়! আগ্রহ ভরে গলায় ঢাললাম; বিস্বাদ তরল জ্বলতে জ্বলতে নেমে গেল পেটে। অতঃপর এর নির্মাতা অর্থাৎ শিরিংয়ের বোন সাংকেতিক ভ্রু উঁচিয়ে ‘কেমন’ জানতে চাইলে, তর্জনি ও বৃদ্ধাঙ্গুলি এক করে সন্তুষ্টির সিগনাল দিলাম, যদিও ততক্ষণে বিস্বাদে ছেয়ে গেছে ভেতরটা।
শুভরাত্রি জানিয়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার ভেতর কুঁজো হয়ে দ্রুত হাঁটলাম দার্জিলিং পাড়ার এদোঁগলিগুলো ধরে ধরে। হোটেলে ঢোকার মুখেই জানা–বাবু ধরে বসলেন, ‘আরে মশাই এই সন্ধ্যা বেলাতেই (তখন রাত আটটা) ঘুমাবেন কি? আসুন একটু গল্প–সল্প করা যাক। অনেকদিন পর একজন বাংলাদেশি ভাইয়ের দেখা পেলাম। ‘অনেকদিন’! প্রশ্নবোধক চোখে তাকাতেই জানা বাবু জানালেন দার্জিলিং এখন বড্ড অশান্ত। পৃথক প্রাদেশিক সরকারের দাবিতে গোর্খারা এখন এখানে প্রায়শই বন্ধ ডাকছে। তাদের এই গোর্খা–মুভমেন্টের কারণে খুনোখুনিও হয়ে গেছে বেশ কয়েকটা। সব মিলিয়ে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। মনে মনে আমার শঙ্কিত হয়ে ওঠাকে লক্ষ করে তিনি জানালেন যে বিদেশি বোর্ডার হিসেবে ইতোমধ্যেই তিনি আমার পাসপোর্ট কপিসহ অন্যান্য তথ্য স্থানীয় থানায় জমা দিয়েছেন নিরাপত্তার খাতিরে। এ সময় মি. সিন্হা (নামটি যদিও পরে জেনেছি) ঢুকলেন হাতে হুইস্কির বোতল নিয়ে। পরিচয় পর্ব শেষে জানতে চাইলেন দার্জিলিংয়ে এই প্রথম কিনা? জানালাম এ নিয়ে তৃতীয়বার। দার্জিলিং কী খুব ভালো লাগে জানতে চাইলে তাকে গ্যাঙটক ভ্রমণের বিফল নাটকটি সংক্ষেপে বললাম। মি. সিনহা প্রস্তাব দিলেন যে উনি অনায়াসেই আমাকে গ্যাংটক নিয়ে যেতে পারবেন। উৎসুক হলাম, জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে। উত্তরে তিনি যে উপায় বললেন তা মোটেও পছন্দ হলো না আমার। পরিবর্তে আমার অদেখা কোনো জায়গায় নিয়ে যাবার অনুরোধ করলাম। এ জায়গা ও জায়গা হয়ে শেষে কালিমপঙ ও লাভার কথা এলো। এর মধ্যে মি. সিন্হা লাভার যে বর্ণনা দিলেন তাতে তখনই রওনা হতে ইচ্ছে হলো। অবশেষে ঠিক হলো আগামীকাল সকাল ৯টা নাগাদ রওনা হবো। হোটেল রুম দু’দিনের জন্যে বুকিং ছিল। তাই জানা–বাবু খানিকটা বুঝি অসন্তুষ্টই হলেন একদিনের বুকিং বাতিলের কারণে; বিশেষত: এখন যখন পর্যটকের ভয়াবহ সংকট।