চট্টগ্রামে গত দুই মাসে পানিতে ডুবে মারা গেছে ১৬ জন। এর মধ্যে দেড় থেকে নয় বছর বয়সী ৯ জন শিশু আছে, যারা পরিবারের সদস্যদের অগোচরে পুকুরে পড়ে যায়। এছাড়া পুকুরে গোসল করার সময় ডুবে মারা যায় তিন শিশু, যাদের বয়স ৮ থেকে ১৪ বছর। এ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, পুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যুর জন্য পরিবারের অবহেলা বা অসচেতনতা দায়ী। এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রামে পানিতে ডুবে ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে আগামী সোশ্যাল ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডুবে মারা যাওয়া ৫১ শিশুর বয়স ৩ থেকে ৫–এর মধ্যে বেশি। সাধারণত এ বয়সের শিশুরা সাঁতার জানে না। ফলে এখানেও পরিবারের অবহেলা রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং ডিজাস্টার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (দাদু) প্রধান নির্বাহী ড. মো. ইদ্রিস আলম মনে করেন, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বয়স্কদের তত্ত্বাবধানের অভাব, গ্রামে শিশু পরিচর্যাকেন্দ্রের অভাব, অতি দারিদ্র্য, পুকুর–জলাধারে নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাব এবং সাঁতার না জানা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৬ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১ থেকে ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুর অন্যতম কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সাধারণত বাড়ির ২০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত জলাধারে এবং দিনের প্রথম ভাগে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। গ্রামাঞ্চলে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার এই হার শহরের চেয়ে বেশি। এর সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে, গ্রামে পুকুর এবং ডোবার মতো ছোট ছোট জলাধারের সংখ্যা বেশি।
সরকারি প্রকল্পে নেই চট্টগ্রাম : পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ২০২২ সালে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু–যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন হয়। জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ২ লক্ষ শিশুকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে শিশু–যত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনা, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের জন্য ১ হাজার ৬০০টি ভেন্যুতে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থা এবং সুইমসেফ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। দেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি জেলাকে এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সেখানে নেই চট্টগ্রাম জেলা। অথচ চট্টগ্রামে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে কম নয়।
শিশু একাডেমির প্রকল্পটি অনুমোদনের পূর্বের বছর (২০২১) গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ জানায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলায় পানিতে ডুবে ৫৭ জন মারা যায়; যা ওই সময় পর্যন্ত অন্য জেলার চেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা। এ পরিসংখ্যান আমলে নিলেও শিশু একাডেমির প্রকল্পে চট্টগ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করা যেত বলে মনে করেন চট্টগ্রামবাসী।
উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৬ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ১৪ হাজার ৪৩৮ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়, যাদের বয়স ১ থেকে ১৭ বছর।
মৃত্যু রোধে উপায় : জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে আসে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং তা হ্রাসের হার শতকরা ৮৮ ভাগের বেশি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকরী বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশু–যত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা–বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।
পুকুরে ডুবে মৃত্যু রোধে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা আগামী সোশ্যাল ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আলমগীর সবুজ আজাদীকে বলেন, পুকুরে ডুবে মৃত্যু রোধে সাঁতার শেখানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ৩ থেকে ৫ বছরের শিশুরা পানিতে ডুবে বেশি মারা যায়। ওই বয়সী শিশুদের তো সাঁতার শেখানো সম্ভব না। এর চেয়ে কম বয়সীও যারা আছে, তারা হামাগুড়ি দিয়ে পুকুরে চলে যেতে পারে। তাই আমরা পুকুরে বেষ্টনী দিতে উৎসাহিত করি। শিশু হামাগুড়ি দেওয়া শিখলে অভিভাবক তাদের বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারে। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না। হয়ত এটা বাস্তবায়ন কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। তাই আমাদের বার্তা হচ্ছে, সাঁতারের পাশাপাশি পুকুরে যেন ঘেরা দেওয়া হয়।
দুই মাসে ১৬ মৃত্যু : চট্টগ্রামে গত দুই মাসে পানিতে ডুবে ১৬ জন মারা গেছে। এর মধ্যে খালে ডুবে মারা যায় এক শিশু। এছাড়া মারা যাওয়াদের একজন মানসিক ভারসাম্যহীন এবং একজন মৃগী রোগী। একজন আনসার সদস্য আছেন, যিনি সাঁতার কাটার সময় মারা যান।
সর্বশেষ ২ নভেম্বর বাঁশখালী ও লোহাগাড়ায় মারা যায় দুই শিশু। মীরসরাইয়ের ধূম ইউনিয়নের আনন্দবাজার এলাকায় ৩১ অক্টোবর পুকুরে ডুবে মারা যায় ৫ বছরের শিশু রায়হান উদ্দিন। খেলাধুলার সময় রায়হান কখন পানিতে পড়ে যায় তা জানত না তার পরিবারের লোকজন। পরে খোঁজাখুঁজি করার সময় পুকুরে ভেসে ওঠা রায়হানের লাশ দেখতে পান স্বজনরা।
বাঁশখালীর শীলকূপ ইউনিয়নের মানিকচর গ্রামে ৩০ অক্টোবর মারা যায় তিন বছরের শিশু নাঈম মণি। ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে খেলতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের অগোচরে বাড়ির পাশে পুকুরে পড়ে যায় সে। একই উপজেলার একই গ্রামে ১৭ অক্টোবর মারা যায় দেড় বছরের শিশু নাজিফা সোলতানা। ওই শিশুও পরিবারের সদস্যদের অগোচরে পুকুরে পড়ে যায়।
১৬ অক্টোবর মীরসরাইয়ের খৈয়াছড়ায় ৪৫ বছর বয়সী নরুল আমিন মারা যান পুকুরে ডুবে। তিনি কয়েক মাস ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। লোহাগাড়ার রূদ্রপাড়ায় ১৩ অক্টাবর মারা যায় ১০ বছরের শিশু রক্তিম চৌধুরী। সাতকানিয়ায় ১ অক্টোবর পুকুরে সাঁতার কাটার সময় মাহমুদুল হাসান মিশু নামে এক আনসার সদস্য ডুবে মারা যান।
এছাড়া লোহাগাড়ায় ৩০ সেপ্টেম্বর খেলার সময় ডলুখালে পড়ে মারা যায় তানজিব নামে পাঁচ বছরের এক শিশু। রাউজানের হলদিয়ায় পুকুরে ডুবে মউনুদ্দিন আহমেদ খসরু নামে নয় বছরের এক শিশু মারা যায় ২৯ সেপ্টেম্বর। বেড়াতে আসা মামাতো ভাইয়ের সাথে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বাড়ির আনুমানিক ৬শ গজ দূরে খেলছিল খসরু। হঠাৎ পুকুরে পড়ে যায় সে।
ফটিকছড়ি পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডে ২৮ সেপ্টেম্বর মাশফিক নামে দেড় বছর বয়সী এক শিশু মারা যায়। পরিবারের সদস্যদের অগোচরে পুকুরে পড়ে যায় শিশুটি। একইদিন বাঁশখালীর বাহারছাড়ায় মারা যায় আদিব নামে দুই বছরের এক শিশু। সে কখন পুকুরে পড়ে যায় জানত না পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া ২১ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে মারা যায় ৫ জন।