হোটেলে চেক ইন করার পর, প্রথমে একটু ধন্দে ছিলাম, আগে নাস্তা করবো নাকি গোসল করবো? গতরাত তো কেটেছে অনাহারে নির্ঘুম ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে। ফলে ক্ষুধায় যেমন পেট চোঁ চোঁ করছিল, তেমনি গলাও শুকিয়ে কাঠ তৃষ্ণায়। তদুপরি এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নেয়ার পর অচিরেই টের পেয়েছিলাম যখন যে, এই মরুতে যেখানে বাঘের ভয় সেখানে শুধু সন্ধ্যাই হয় না, সাথে স্বয়ং বাঘ এসেও হাজিরা দেয়! তুমুল হতাশ হয়ে তখন সেই আপ্তবাক্যটিকে কবুল করে নিতেই হয়েছিল! মানে যাহা আমার নিয়ন্ত্রণে নাই, তাহা লইয়া মাথা কুটিয়া কোনই লাভ নাই।
তবে তারপরও নো টেনশন ডু ফূর্তি করতে তো আর পারবো না, তারচে বরং একটু ঘুমানোর চেষ্টা করি। হয় যা কপালে হবে তা তারপর! দুর্ভোগের রাত পার হয়ে যদি শুরু হয় অবশেষে দুর্ভোগের দিন করার তো কিছু নাই। ফলে নিজের চিরাচরিত যে নিয়ম, কোন নতুন শহরে গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে বাতচিত করে সেই শহর ও দেশের অন্দরমহলের খবর নেয়া, তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে, পেছনের সিটে বসে একটা ঘুম দেবার চেষ্টাই করেছিলাম।
হ্যাঁ একটু খোলাসা ওরা যাক ঘটনা, তা হচ্ছে এয়রাপোর্টের ব্যাংকের আমার সেই কালা ভাইয়ের বদান্যতায় ডলার ভাঙ্গিয়ের রিয়াল হাতে পাওয়ার পর, দ্রুত ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের সাইন ধরে এগিয়ে, লাউঞ্জের বাইরে এসে দেখেছিলাম আধা ডজনের মতো ট্যাক্সি ঠায় দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে। আর ওগুলোর চলাকদের তিনজন এক পাশে দাঁড়িয়ে গুলতাপ্পি মারছে। বাকি দুইজনের একজন আমাকে দেখেই, হাত পা তুমুল নাড়িয়ে আরবিতে কিছু একটা বলতেই, গুলতাপ্পি মারা তিনজন একযোগে আমার দিকে নজর দিয়ে হাসাহাসি করি নিজেদের মধ্যে কি সব যেন বলতে শুরু করেছিল।
অল্পবিস্তর যা জানতাম সৌদি ট্যাক্সি বিষয়ে, তার ভিত্তিতে নিরাপত্তার খাতিরে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম এখানে পারতপক্ষে কখনোই সৌদি ট্যাক্সি ড্রাইভারচালিত ট্যাক্সি নেব না। পোশাকে আশাকে ঐসব ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সৌদিই মনে হচ্ছিল। অতএব তাদের ঐসব হাসাহাসি দেখেও না দেখার ভান করে সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম, উপমাহদেশিয় কোন ট্যাক্সি ড্রাইভারের খোঁজে, কারন সামনের এই ট্যাক্সিগুলোর মাঝখানে বেশ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আরো কটা ট্যাক্সি দেখতে পাচ্ছিলাম রাস্তাটির শেষ মাথায়। দূরের সেই ট্যাক্সিগুলো লক্ষ করে আগমনি লাউঞ্জের বহিরঙ্গয়ের টানা লম্বা এই করিডোর ধরে কিছুদূর এগুবার পর, হঠাৎ করেই একটা থামের আড়াল থেকে খাজুইরা উচ্চারণের হলেও মোটামুটি পরিষ্কার ইংরেজিতে প্রশ্ন ছুটে এসেছিল যে, শহরে যাওয়ার জন্য আমার ট্যাক্সি লাগবে কি না?
প্রশ্নের উৎসের দিকে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি মোটামুটি মহাদেশীয় আকার ও আকৃতির, নিল জিন্স,চক্রাবক্রা পলো সার্ট আর স্নিকারস পরা স্মার্ট এক তরুণ তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে। আচ্ছা এ কি ফিলিস্তিনি নাকি মিশরি? ভাবতে ভাবতে হ্যাঁ বোধক জবাব দিয়ে, গন্তব্য আমার ম্যারিয়ট রিয়াদ হোটেল জানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তা ভাড়া কতো ভাতিজা?
“ওয়ান ফিফতি রিয়াল।“
ভাড়া তো জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু নিজেই তো জানি না কতো হওয়া উচিৎ ভাড়া! ছিলাম তো হোটেলের পিক আপ সেবার ভরসায়। এদিকে বিধি তো হয়েছিল আমার বাম হতে শুরু করেছিল ঢাকাতেই সাউদিয়ার যান্ত্রিক বিড়ম্বনার কারণে। ফলে চার ঘণ্টারও বেশী সময় বিলম্বে এসে পৌঁছেছিলাম গতরাতে এখানকার স্থানীয় সময় রাত দশটা সাড়ে দশটার দিকে। তারপর তো গোটা রাত কেটেছে ইমিগ্রেশন লাইনে, ফলে খুব স্বাভাবিক কারণেই ধরে নিয়েছিলাম হোটেল থেকে পাঠানো গাড়ী নাই এ অধমের কপালে! আগে থেকেই তাই বিকল্প হিসাবে ভেবেছিলাম যাবো মিটার ট্যাক্সিতে। অতএব ট্যাক্সি ভাড়া নিয়ে দরদাম করার কোন প্রস্তুতি তো ছিল না মনে। ফলে পড়লাম তো এখন ঝামেলায়! কিন্তু তাতেই বা কী? বিনা দরদামেতো এই বাঙালী উঠতে পারে না ট্যাক্সিতে কিছুতেই, ভাবতে ভাবতে আন্দাজে ঢিল ছুড়ে হাসতে হাসতে বলেছিলাম
কি যে বলো না ভাতিজা? চল দেব একশ!
সাথে সাথেই পিছু হটে সে বলেছিল, একদর তার একশ বিশ। এতে যদি রাজী হই, তবে আমি যেন তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে এমনভাবে এগুই, যাতে মনে হয় আমরা দুজন খুব পরিচিত এবং এসেছে সে, আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যেতে। এই ফাঁকে সে এও জানিয়েছিল যে গাড়িটা তার ট্যাক্সি নয় মোটেও। ব্যক্তিগত গাড়ী ওটা তার। সবসময় না, মাঝে মধ্যে সে বাড়তি দু পয়সা কামানোর জন্য এরকম ট্রিপ দেয়। এখন যদি বিশেষত পেছনের সৌদি ট্যাক্সি ড্রাইভারেরা তা টের পায়, তবে হাঙ্গামা করবে।
তার বয়ান শুনে ভেবেছিলাম, সেই গতকাল দুপুরে থেকে এই একটু আগ পর্যন্ত হাঙ্গামা তো কম পোহাই নাই। নতুন হাঙ্গামার সাধ নাই আর! দ্রুত তাই বেশ অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে ওর সাথে হাত মিলিয়ে ওকে বলে তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগুতেই, “ওয়েত হিয়ার। কামিং উইথ কার’ বলে সে করিডোর ছেড়ে বাঁয়ে গোত্তা মেরে এরাইভাল লাউঞ্জের দিকে এগিয়ে ওখানকার একটা লিফটের দিকে এগুতেই মনে হল যাচ্ছে নিশ্চয়ই সে এখানকার পার্কিং লটের দিকে।
তাতে এইখানে এসে পৌছুবার পর এই প্রথম নিজেকে একটু নিশ্চিন্ত মনে হতেই টের পেলাম লাগছে গায়ে এই সকালেও মরুর ভাপ। আসলে এই করিডোরে আসার আগ পর্যন্ততো ছিলাম শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের কারিশমায় তৈরি শীতলতায়। তবে মনে ছিল না এসেছি মরুর বুকে। লাউঞ্জের ছাদ পেরিয়ে এসময় চোখ বাইরে যেতেই, দেখতে পেলাম চকচকে নাঙ্গা তলোয়ারের মতো রুপালি রোদ। রোদের চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে এই সকালেই দিবাকর মহাশয়ের মেজাজ আছে তেতে। মরুবালিতে অবিরল ঘষে ঘষে শানাচ্ছেন তাই তিনি তার নাঙ্গা তলোয়ার।
আচ্ছা, ঐ যে লাল গাড়িটা বেরুলো বাঁ দিকের মাটি ফুঁড়ে এবং আসছে যেটা এখন এটা এদিকেই, ওটাই কি বাহন নাকি আমার? ভাবতে ভাবতেই সেটা এসে একদম গা ঘেঁসে এসে ঘ্যাঁচ করে দাঁড়ানোর সাথে সেটির জানালার কাঁচ নেমে যেতেই এগিয়ে তাতে উঁকি দিয়ে নিশিচত হলাম যে, ঠিকই আছে । যদিও আগে থেকেই জানতাম, তারপরও জানালায় উঁকি দিয়ে ড্রাইভিং সিটটাকে উল্টা পাশে দেখে মনে পড়লো ,উহ এখানে তো আবার সব আম্রিকান কেতা!
এদিকে আমার চালক মুখে কী যে বলছে দ্রুত, তা পরিষ্কার না বুঝতে পারলেও, তার হাতের নাড়াচাড়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ীর পেছনের বুটে দ্রুত সুটকেসটি গুঁজে দিয়ে উঠে পড়েছিলাম নিজেও গাড়ির পেছনের সিটে।
অতপর, ফের কোন হাঙ্গামায় যাতে না পড়ি সে লক্ষে হোটেলের ঠিকানা সম্বলিত রিজার্ভেশনের কাগজটা পিছনের সিট থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম তার হাতে, যাতে ভুল করে সে আবার যেন না নিয়ে যায় অন্য হোটেলে। এই রিয়াদে কয়টা যে ম্যারিয়ট আছে তা তো জানি না।
ওটা হাতে পেয়ে, “ওকে’ বলে সে এক্সলেটরে চাপ দিতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, লাগবে কতক্ষণ? উত্তরে ৪০/৫০ মিনিট বলেই আগমনী লাউঞ্জের চত্বর পেরিয়ে শহরমুখী রাস্তায় যখন গাড়ী উঠেছিল, কিছুটা কৌতুকের স্বরেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, তা ভাতিজা এসেছো তুমি কোন মুল্লুক থেকে?
“সৌদি। মি সৌদি”
সাথে সাথে মুখে দ্যাটস গুড বললেও, মনে মনে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম চালকের আসন থেকে এই উত্তর আসতেই। যে দুর্ভোগের ভয়ে সৌদি ট্যাক্সি নিলাম না জেনে শুনে, না জেনে কী না অবশেষে জুটল তাই কপালে! হায়রে কে জানে? আরো কতো দুর্ভোগ যে আছে লেখা এই মরুতে এই বাঙালির কপালে! আশার কথা এটাই যে, ফকফকা চারদিক এখন সুয্যি মামার দয়ায়। গ্রীক ট্রাজেডির বড় বড় নায়কেরাই যখন নিয়তিকে উপেক্ষা করতে পারে নি, সেখানে আমি তো কোন ছার। অতএব মাথা থেকে সব টেনশন ঝেড়ে, পেছনের সিটে হাত প ছেড়ে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমের তপস্যায় লেগে গিয়েছিলাম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম বা ঝিমিয়েছিলাম তা জানি না। কারণ গাড়ীর গতি পরিবর্তনের কারণে বেশ ক’বারই ঝিমানো বাঁ ঘুমানো চটে গিয়েছিল। মন তখন যতোই বলুক না কেন “কে বা আখি মেলেরে” তারপরও চোখ মেলে একবার বাইরের দিকে দৃকপাত করে ফের চোখ মুদেছিলাম, হয়েছিল যেমন ঢুকেছিল গাড়ী যখন হোটেলের চত্বরে, তাতে ধড়ফড় করে উঠে বসেছিলাম যাতে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হতে পারি গাড়ি থেকে।
সে মত অতপর বেশ দ্রুতই গাড়ি বিদায় করে ম্যারিয়টের চেক ইন কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াতেই, স্যুটেড বুটেড কাউন্টারম্যান এইসব হোটেলের মার্কামারা হাসি মুখে লেপটে অলস চোখে তাকাতেই , তার দিকে পাসপোর্ট এগিয়ে ধরে তাড়া দিয়ে বলেছিলাম, দেখোতো আমার নামে একটা রিজার্ভেশন থাকার কথা, আমি সে রুমে যেতে চাই দ্রুত।
কাজ হয়েছিল তাতে। আলসেমি ঝেড়ে ফেলে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দ্রুতই সামনের কম্পিউটারে কিছুক্ষণ খুটখাট করার পর, পেছনের রুমে গিয়ে পাসপোর্টের নির্দিষ্ট অংশের ফটোকপি করার পর, পাসপোর্ট আর রুম কি কার্ড আমার হাতে তুলে দিতে দিতে যতোই সে হাসিমুখে তাগালোগ মানে ফিলিপিনো টোনে বলুক না কেন
“ওয়েলকাম টু ম্যারিয়ট রিয়াদ। এঞ্জয় ইউর স্টে।” মনে মনে বিরক্তই হয়েছিলাম। ভাবছিলাম, আরে মিয়া আমার তো চেক ইন করার কথা ছিল গতরাতে। তোমাদের গাড়ীও তো যাওয়ার কথা ছিল তখন আমাকে পিক আপ করার জন্য। সে জায়গায় প্রায় দশ এগার ঘণ্টা এই আমি যে ছিলাম কোন চুলায়, তার তো কোন খোঁজ নিলা না। রিজার্ভেশন দেয়ার সময় কখন আসবো তা তো দেয়া ছিল! না হয় এই সকালেই তো আমাকে চেক ইন করতে দিতা না। মুফতে যে এক রাতের ভাড়া নিয়া নিলা, তার জন্য হলেও তো জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল কথাটা তোমার! বুঝতেই পারছি যতোই পাঁচ তারা হোক হোটেল, তুমি মিয়া এর যোগ্য না। যতই বিরক্তি টগবগ করে থাকুক না কেন মনে, জোর করে তা চেপে রেখে উল্টা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে, চারতলার নির্দিষ্ট রুমে যাবার জন্য লিফটের দিকে এগুতে এগুতে পড়েছিলাম ধন্দে বলেছি যা শুরুতে। অবশ্য লিফটে উঠতে উঠতে দ্রুতই সেই ধন্দ কাটিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলাম পরবর্তী করণীয়।
সে মোতাবেক সেই ঘণ্টা খানেকেরও বেশি সময় আগে গোসল টোসল সেরে, নাস্তা করে, ঘুম তাড়ানিয়া একটা ডাবল এস্প্রেসো কফি মেরে, রুমে ফিরে অফিসে যাবার জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে বসে আছি সোফায় হল মিনিট দশেক। নিয়মমাফিক কেউ না কেউ আসার কথা। তবে আসবে যে কখন তা তো অবশ্য নই নিশ্চিত। এ কথা ভাবতেই আমাকে “আর নয় ভাবনা” বলতেই যেন বেজে উঠেছিল রুমে ফোন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।