চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) পড়াশোনা করছেন ২৭ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী। আশা আর প্রত্যাশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও নানা কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হন অনেক শিক্ষার্থী। পরিবারের সাথে বিচ্ছেদ, প্রেমে দ্বন্দ্ব, প্রতারণার শিকার কিংবা আর্থিক টানাপোড়েনে শিক্ষার্থীদের হতাশায় ভুগতে দেখা গেছে। এই হতাশা তাদের অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। সবার মধ্যে থেকেও তারা হয়ে যান একা। একটা সময় হতাশায় থাকা মানুষটা বেঁচে থাকার অর্থ হারিয়ে ফেলেন। বেছে নেন আত্মহননের পথ। গত এক যুগে এভাবে চবিতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন অন্তত ১৬ জন শিক্ষক–শিক্ষার্থী।
এদিকে ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। কেউ হতাশাগ্রস্ত হলে কাউন্সেলিং করাবেন, সে রকম কোনো ব্যবস্থা চবিতে নেই। যার কারণে চবি ক্যাম্পাসে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিটি আত্মহত্যার পর চবি কর্তৃপক্ষ উদ্যোগের বাণী শোনান। কদিন যেতেই অন্তরালে চলে যায় সেটি। সবশেষ গত ১ নভেম্বর অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তাজরিয়ান আহমেদ সোয়ারা আত্মহত্যা করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ না থাকার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। জানা গেছে, পরিবারের সাথে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না ওই শিক্ষার্থীর; যার কারণে বেছে নেন আত্মহননের পথ।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের দ্বিতীয়তলায় শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিং সেবা চালু করা হয়। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রকোপ শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় এই সেবা। এই সেন্টারে সেবা নিয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। তাদের অনেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন এবং ইতিবাচক সাড়া মিলেছে বলে জানান শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বর্তমান সময়ে প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। অনুষদগুলোতেও কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর জন্য পরামর্শ ও নির্দেশনা কেন্দ্র থাকলেও সেখানে এ বিষয়ে পেশাদার কেউ নেই। ফলে নানা মানসিক টানাপোড়েন ও উদ্বেগ সঙ্গী করেই দিন পার করতে হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, গত এক বছর পর্যন্ত তিনি নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বজন হারানোর বেদনা ও পারিবারিক সমস্যা। সামগ্রিকভাবে এসবের প্রভাব পড়েছে তার পড়াশোনায়। হতাশা ও মানসিক অস্থিরতায় টিকতে না পেরে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে। কিন্তু সেখানে কোনো মনোরোগবিদ না থাকায় সেবা না পেয়ে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সমস্যার সমাধান না পেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলের একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। ওই বিশেষজ্ঞ তাকে নিয়মিত কয়েকটি কাউন্সেলিং সেশন নেওয়ার পরামর্শ দেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের দূরত্ব বেশি হওয়ায় নিয়মিত কাউন্সেলিং চালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি ছাড়াও চবির বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী এমন সমস্যার কথা জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দাবি, মানসিক সমস্যা থেকে উত্তরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার ও অনুষদগুলোতে সাইকিয়াট্রিস্ট রাখতে হবে। এ নিয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২১–২২ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো জানেনও না কোথায় গেলে তারা কাউন্সেলিং সেবা পাবেন। এখানে শিক্ষার্থীদের মানসিক অসুস্থতার জন্য কোনো সেবা নেই।
দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শিমুল বলেন, শারীরিক সুস্থতার সাথে সাথে মানসিক সুস্থতাও প্রয়োজন। এই বৃহৎ মানবসম্পদের উৎস যদি মানসিকভাবে সুস্থ না থাকে, তাহলে তারা দেশের উন্নয়নের জন্য সর্বোচ্চ অবদান রাখতে ব্যর্থ হবে।
চবি মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লাইলুন নাহার আজাদীকে বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা একটি মানসিক ব্যাধি। এটা নানা কারণে হয়ে থাকে। এর জন্য সঠিক কাউন্সেলিং দরকার। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল সেটি পুনরায় চালু করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে অনেকেই উপকৃত হবেন। এছাড়া পরিবারসহ সকলের এক্ষেত্রে ভূমিকা থাকা দরকার।