নগরের অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা পরিশোধ, ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ফি আদায় এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় নির্বাহ করা হয় দুটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক মুরাদপুর শাখা এবং প্রাইম ব্যাংক প্রবর্তক শাখায় রয়েছে এ দুটি হিসাব। এখানে লেনদেনের ক্ষেত্রে চেকে যৌথ স্বাক্ষর করার ক্ষমতা আছে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির। এ ক্ষমতাবলে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ম্যানেজিং কমিটির ‘সভাপতি’ হিসেবে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন স্বাক্ষর করে আসছেন। একইসঙ্গে চলতি বছর বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া কবিতা চৌধুরী স্বাক্ষর করছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ‘আত্মগোপনে’ চলে যান আ জ ম নাছির। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলাও হয়েছে। ফলে প্রকাশ্যে আসছেন না তিনি। কিন্তু গত প্রায় ৩ মাস ধরে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন–ভাতা পরিশোধসহ অন্যান্য ব্যয় নির্বাহে ব্যাংক হিসাবের চেকে স্বাক্ষর রয়েছে তার। প্রশ্ন উঠেছে, কেউ কি আ জ ম নাছিরের স্বাক্ষর ‘জাল’ করছেন? নাকি বিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল কেউ গোপনে তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে স্বাক্ষর নিয়ে আসছেন?
এদিকে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২ জুলাই আ জ ম নাছির উদ্দীনকে সভাপতি এবং প্রধান শিক্ষককে পদাধিকার বলে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত ৭ সদস্যের একটি ম্যানেজিং কমিটি ২ বছরের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে ৪ সদস্যের একটি অ্যাডহক কমিটি ৬ মাসের জন্য অনুমোদন দেয় বোর্ড। একই বছরের ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ওই অ্যাডহক কমিটির সভায় ‘শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন–ভাতা প্রদান, দৈনন্দিন ব্যয়, পরীক্ষা পরিচালনা ব্যয়, ছাত্রছাত্রীদের রেজিস্ট্রেশন, ফরম ফিলআপ এবং উন্নয়ন ব্যয়সহ নানাবিধ খরচ নির্বাহের জন্য বিদ্যালয়ের নামে পরিচালিত হিসাবসমূহের ব্যাংক অপারেটরের নাম বা স্বাক্ষর পরিবর্তন’–এর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়নি।
বোর্ডের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বর্তমানে কোনো ম্যানেজিং কমিটি নেই। তাই ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে আ জ ম নাছিরের স্বাক্ষর করারও সুযোগ নেই।
তবে বিদ্যালয়ের শিক্ষক–কর্মকর্তাদের দাবি, অ্যাডহক কমিটির বিরুদ্ধে রিট করেন আ জ ম নাছির। আদালত অ্যাডহক কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) কবিতা চৌধুরীর দাবি, গত ৩০ মে থেকে পূর্বের কমিটি (আ জ ম নাছিরকে সভাপতি করে গঠিত কমিটি) বহাল আছে।
বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলছেন, ২০১৯ সালে আ জ ম নাছিরকে সভাপতি করে ২ বছরের জন্য অনুমোদিত কমিটি ৫ বছর পরও বহাল থাকে কীভাবে? তাছাড়া সর্বশেষ অ্যাডহক কমিটির পর বোর্ড নতুন করে কোনো কমিটি অনুমোদন দেয়নি। ফলে অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে কার্যত ম্যানেজিং কমিটিহীন আছে অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
মাসে খরচ কত : অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক আছেন ৫৬ জন। অন্যান্য কর্মচারীসহ এ সংখ্যা ৭৯। তাদের বেতন–ভাতা বাবদ মাসে খরচ হয় প্রায় ২০ লাখ টাকা। এছাড়া ৬০ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল, ৫ হাজার টাকা পানির বিল খরচ হয়। বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী আছে ৩ হাজার ২০০ জন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন ফি বিদ্যালয়ের প্রধান আয়।
প্রাইম ব্যাংকে থাকা হিসাব দিয়ে শিক্ষক–কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করা হয়। এছাড়া ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং প্রাইম ব্যাংকের দুটো হিসাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ফি নেওয়া হয়। এছাড়া এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাসিরাবাদ শাখায় একটি হিসাব থাকলেও বর্তমানে তা সচল নেই।
কী বলছেন প্রধান শিক্ষক : অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) কবিতা চৌধুরী গত বুধবার রাতে মোবাইল ফোনে আজাদীকে বলেন, অ্যাকাউন্টস থেকে উনার (আ জ ম নাছির উদ্দীন) স্বাক্ষর সম্বলিত চেক আনলে আমি স্বাক্ষর করি। উনার স্বাক্ষর থাকলেই আমি করি, অন্যথায় করি না। ওরা (হিসাব শাখার কর্মকর্তা–কর্মচারী) কীভাবে আনে আমি জানি না। তবে ধারণা করছি উনার স্বাক্ষর করা চেক আছে। আমার সঙ্গে উনার (আ জ ম নাছির) যোগাযোগ নেই। আমি নিজেও উনার (আ জ ম নাছির) সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি, পারিনি। উনি কোথায় আছেন আমি জানি না।
এর আগে একইদিন দুপুরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দপ্তরে তিনি বলেন, শিক্ষকদের বেতন ব্যাংকের মাধ্যমে হয়। এখন পর্যন্ত কারো বেতন বকেয়া নেই। গত মাসেও সবাই বেতন পেয়েছেন।
ওই সময় ‘৫ আগস্টের পর থেকে আ জ ম নাছির উদ্দীন আত্মগোপনে আছেন। বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবের লেনদেনের ক্ষেত্রে তার স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে লেনদেন কীভাবে হচ্ছে’ জানতে চাইলে বলেন, এটা (বিদ্যালয়) সোসাইটির (দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি.) প্রতিষ্ঠান। সোসাইটির অফিস থেকে সবকিছু পরিচালিত হয়। তারা ভালো বলতে পারবেন।
তিনি বলেন, আমি নিজে রিটায়ার করেছি। নতুন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়। দায়িত্ব নেওয়ার সময় আমাকে বলা হয়েছিল অল্প সময়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। পরে নিয়োগ প্রক্রিয়াও শুরু হয়। ২ আগস্ট তিনি (আ জ ম নাছির উদ্দীন) স্কুলে আসেন এবং ইন্টারভিউও নিয়েছেন। নিয়োগটা হয়ে গেলে আমি বেঁচে যেতাম।
আ জ ম নাছিরের অনুপস্থিতিতে ব্যাংক হিসাবের লেনদেন প্রসঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টস অফিসার ইমরান হোসাইন আজাদীকে বলেন, আমি যতদূর জানি একক স্বাক্ষরে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট আলংকারিক পোস্ট, মেম্বার সেক্রেটারি অল ইন অল।
অ্যাডহক কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্যালয়ের নামে পরিচালিত হিসাবসমূহের ব্যাংক অপারেটরের নাম বা স্বাক্ষর পরিবর্তন না করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, অ্যাডহক কমিটি হওয়ার তিন–চার দিনের মধ্যে স্টে (স্থগিত) হয়ে যায়, পূর্বের কমিটি দায়িত্ব পালন করে। তাই আর পরিবর্তন করতে হয়নি।
কী বলছেন সোসাইটির দায়িত্বশীলরা : দি চিটাগাং কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি.-এর সঙ্গে অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আর্থিক পরিচালনার কোনো সম্পর্ক নেই বলে আজাদীর কাছে দাবি করেছেন সোসাইটির ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মামুন–অর–রশীদ। গত বুধবার দুপুরে সোসাইটি কার্যালয়ের নিজ দপ্তরে তিনি বলেন, বিদ্যালয় সোসাইটির প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ব্যবস্থাপনা ও হিসাব–নিকাশ সব আলাদা। এর সঙ্গে সোসাইটির কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি দাবি করেন, সোসাইটির সভাপতি বা তার প্রতিনিধি অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হয়ে থাকেন। বর্তমানে সোসাইটির সভাপতি হচ্ছেন মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। তিনি বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে না থাকায় তার প্রতিনিধি হিসেবে আ জ ম নাছির উদ্দীন আছেন। কিন্তু বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির যাবতীয় কার্যক্রম শিক্ষা বোর্ডের নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এখানে সোসাইটির কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
বোর্ডের বক্তব্য : চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী গত বুধবার আজাদীকে বলেন, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি না থাকায় আমাদের কাছে কেউ সমস্যার কথা বলেনি। তবে এর মধ্যে তো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সরকারি সার্কুলার হয়েছে, কমিটির সভাপতি না থাকলে জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা স্বাক্ষর করবেন।
প্রকাশ্যে না থেকেও বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে আ জ ম নাছির উদ্দীনের স্বাক্ষর করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওখানে তো কমিটির কোনো অস্তিত্ব নেই। আমরা কোনো কমিটির অনুমোদন দিইনি। কমিটি থাকলে আমরা অ্যাডহক কমিটি দিলাম কী করে?
অ্যাডহক কমিটির বিরুদ্ধে রিট করলে পূর্বের কমিটিকে বহাল করার দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ রকম কোনো আদেশের কপি তো আমার কাছে আসেনি। অ্যাডহক কমিটি হওয়ার পর বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে স্বাক্ষর প্রদানকারীর ক্ষমতা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত থাকলেও তা কার্যকর না করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, আসলে আমরা ওখানে তদন্ত করার জন্য অনেক চিঠিপত্র দিয়েছি। অনিয়ম বা দুর্নীতি যদি কিছু থাকে তা খুঁজে বের করার জন্য তদন্ত কমিটিও গঠন করে দিয়েছি। ওই রিপোর্ট এখনো পাইনি।