সুখময় দাস আজ ঠিক করেছে কোনো কাজ করবে না। সারাদিন শুধু নিজের ইচ্ছেমতো এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা, এক গলি থেকে আরেক গলি, স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবে। স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিতেই বাপ–দাদার ব্যবসা ছেড়ে সে রিক্সাচালক। রিকশা চালিয়ে সে পুরো শহর ঘুরে বেড়ায়। কারো কথাতে সে রিকশা চালায় না, নিজের ইচ্ছাতেই কাজ বন্ধ করে সটান হয়ে রিকশার উপর ঘুমিয়ে পড়ে।
বাপ–দাদা তার নাম দিয়েছে সুখময় দাস। সুখ তার কাছে ধরা দেয় না। নিজের সুখ সে নিজেই রচনা করে।
সুখময় দাসের ঝুপড়ি ঘর। ছোট একটু জায়গা নিয়ে ‘ঘর’। চৌকিতে উঠলে মাথা নিচু করে রাখতে হয়, নইলে ঘরের চালের সাথে মাথা বাড়ি খায়।
‘অবন্তি দাস’ সুখময় দাসের একমাত্র কন্যা।
অবন্তি ভেজা মাটির উপর ছালা বিছিয়ে কমলা রঙের বরফের টুকরো জিভ দিয়ে চেটে চেটে খাচ্ছে। সেই বরফের টুকরোর নাম ‘আইস ললি’।
বেড়ার দরজা ঠেলে সুখময় ঘরে প্রবেশ করে,
অবন্তি, কি করস?
অবন্তি: খাই
তোর মায় কই?
অবন্তী: কল পাড়ে
সন্ধ্যার সময় কলপাড়ে গেছে কেন? আগে যাইতে পারে নাই?
সুখময় বিছানায় গা এলিয়ে দিল, সুখময়ের ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার, বাপ– মেয়ে চুপচাপ ক্ষণ পার করেছে। ঘরের চালের টিনের কিছু অংশ ভাঙ্গা, ভাঙ্গা টিনের ফাঁকা দিয়ে সন্ধের ফিকে আলো সুখময়ের ঘরে উঁকি দিচ্ছে।
অবন্তি তোর মায়েরে ’ক খাওন দিতে…
খাওয়া শেষে অবন্তির মায়ের কাঁসার থালা–বাটি, ধোয়ার টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। কম পাওয়ারের আলোতে সুখময়ের ঘর গোলাপি রঙ ধারণ করেছে।
সুখময়ের পাশের ‘ঝুপড়ি’ ক্ষিতিশের ঘর। ক্ষিতিশের মায়ের ‘ক্ষয়রোগ’। খক্খক্ শব্দে ক্ষিতিশের মা কাশছে।
ক্ষিতিশের ঘরের বেড়ার কিছু অংশ ফাঁকা, ফাঁকা বেড়া দিয়ে ক্ষিতিশের ঘরের রঙিন টেলিভিশন দেখা যায়। অবন্তির পলক না ফেলা চোখ ঘন্টার পর ঘন্টা সেই টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে।
একসময় পুরো দাসপাড়া ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমদেবী ধরা দেয় না কেবল ক্ষিতিশের মায়ের চোখে আর দাস পাড়ার কোপ খাওয়া সাদা কুকুরের চোখে।
নিঝুম দাসপাড়ায় ক্ষিতিশের মায় খক্ খক করে ঘন্টা বাজিয়ে চলে ।
সুখময় এর সুখঘুম ভাঙ্গে বমির শব্দে, অবন্তি ওয়াক ওয়াক শব্দে বমি করে চলছে। অবন্তীর মা ছোট একটা বাটি অবন্তরি মুখের কাছে ধরে
রেখেছে। বমির টক গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।
সুখময়: অর কি আবারো জ্বর আইছে?
অবন্তির মা: ‘হ’
দিনদিন মাইয়াটার অসুখ বাইরা যাইতেছে, রাইত অইলে জ্বর আহে আর দিনভরা কাশে। মাইয়াটারে লইয়া কি করুম ‘সুখময়’ মনে মনে ভাবে।
অবন্তির মা: মাগো কিছু খাইবি? তোর লাইগা কিছু কি আনুম?
অবন্তি: হ
অবন্তীর মা: কি আনুম।
অবন্তি: জিলাপি।
অবন্তীর মা: ওর লাইগা কয়টা জিলাপি আইনেন তো–
আইজকা অরে একটু মাতৃসদনে লইয়া যাইবেন, ওই হানে ডাক্তার আপায় কোন টেকা লয় না। ফ্রি–তে ওষুধও দেয়। আমার মাইয়াডারে একটু লইয়া যাইয়েন।
অবন্তির মা সুখময় এর কাছ থেকে কোন উত্তর পায় না।
ঝুপড়ির দুয়ার খুলেই সুখময় কোপ খাওয়া সাদা কুকুরের দেখতে পায়, মাথা–লেজ শরীরের ভিতর ঢুকিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে কুকুর, কারা যেন কুকুরের শরীরে গোলাপি রঙের চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।
মনের জোর লাগিয়ে সুখময় কুকুরের গায়ে এক লাথি দেয়,
কুকুর কোঁক শব্দে ছিটকে পড়ে।
মনের মতো লাথি লাগিয়ে সুখময় মনে সুখ পায়।
আইজ মন দিয়া কাজ করুম। অনেক ভাড়া টানুম। সুখময় মনে মনে বিড়বিড় করে। প্রায় নয় হাজার টাকার দরকার। ৭৩৭৫ টাকা সে জমিয়েছে। আর কয়টা টেকা হইলেই হইয়া যাইবো। দুপুর তিনটা পর্যন্ত ভাড়া টানে, যাত্রী পঞ্চাশ টাকার বদলে ৩০ টাকা ভাড়া দেয়,
ওই মিয়া এইটা কি দিলা, আরো ২০ টেকা দাও–
যাত্রী: যা দিসি এইটা নিয়ে হাঁট,
কম দিলা কেন? টেকা দাও–
যাত্রী: এক থাপ্পড় খাবি ,যা এখান থেকে।
সুখময় রিক্সা ঘুরিয়ে গালি দেয়। জোরে জোরে রিক্সা টানে আর গালি দিতে থাকে, মুখ থেকে এক দলা কফ ‘থু’ শব্দে ফেলে।
বিকেল চারটা নাগাদ গাড়ি চালিয়েছে। একটা হোটেলে ঢুকে, হোটেলে বড় একটা কালো কড়াই, তাতে টুপটুপে গরম তেল, আর সেই তেলে ভাজা হচ্ছে ‘জিলাপি’। জিলাপি তেলে একবার ডুবছে, একবার ভাসছে। জিলাপির সুবাসে হোটেল ম ম করছে।
সুখময়: ওই ছেরা দুইডা জিলাপি দে–
হোটেল বয় নীল প্লেটের উপর খবরের কাগজ বিছিয়ে দুটো জিলিপি দিয়ে যায়।
সুখময় এক টুকরো মুচমুচে জিলাপি মুখে পুরে নেয়, জিলাপির টুকরো প্রথমে ডান গালে পরে বাম গালে ঘুরিয়ে তালুতে যেয়ে আটকায়। জিভ দিয়ে সেই জিলেপিকে ডান গালের সাথে ঘষতে থাকে। তারপর হালকা করে মাড়ির দাঁত দিয়ে চাপ দেয়। ফুস করে জিলাপির ভেতর থেকে মিষ্টি রস বেরিয়ে আসে। আবার বলের মতন ঘুরিয়ে আর একটু জোরে চাপ দেয়, আবারো রস বেরিয়ে আসে।
আহ কি মজা…
দুটো জিলাপি খেয়ে শেষ করে, কাগজের টুকরো দিয়ে হাতমুখ মুছে বেরিয়ে আসে।
জিলাপি খেয়ে তৃপ্তি পেয়ে সুখময় মনে মনে ভাবে–
বাপ–দাদায় নাম রাখছে সুখময় দাস/সুখ আমার কাছে ধরা দেয় না,/আমি সুখেরে ধইরা লই।
সন্ধ্যায় সুখময় বাড়ি ফেরে।
অবন্তি …অবন্তি…
দুয়ারে কোপ খাওয়া কুকুর, কুকুর ঠেলে অবন্তি ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, বাপের ঘাড়ে একটা ‘টেলিভিশন’, আর হাতে কাগজে মোড়ানো জিলাপি।
অবন্তি চিৎকার করে ওঠে, মাগো দেহ বাবায় কি লইয়া আইছে।
সন্ধ্যাটা খুব আনন্দে কাটে বাবা–মেয়ের। অবন্তির মায়ের পলক না–ফেলা চোখ, একসময় পলক ফেলে। নাকের দুই অংশ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে।
রাত গভীর।
অবন্তির মা মেয়ের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে।
সুখময়ের এক হাত অবন্তির গরম হাতকে স্পর্শ করে। সে অনেকক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
অবন্তির মুখের শ্রী খুব সুন্দর।
গোল চ্যাপ্টা, গায়ের রং কালো। থুতনির নিচে ভাঙ্গা, বড় বড় চোখে তাকে প্রতিমা বলে মনে হয়, পুরু ঠোঁট দুটো বড় মায়াময়। গলায় ‘তুলসীর মালা’ তাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
মায়ের মতোই তুলতুলে শরীর। বেঁচে থাকলে মেয়েটা মায়ের মত শ্যামসুন্দরী হবে।
রাত যতই গভীর হচ্ছে অবন্তির জ্বরের কাতরানোর সাথে তাল মিলিয়ে কাশি দিয়ে যাচ্ছে ক্ষিতিশের মা। অবন্তির মা একসময় জ্বরে কাতরানো মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেয় কিন্তু মা নিজে অঝোরে কাঁদতে থাকে। সবকিছুকে পিছে ফেলে অবন্তির বাবা পাশবালিশে হাত–পা ছড়িয়ে সুখের ঘুমে নিজেকে ছেড়ে দেয়।
আজ সোনাঝরা রঙিন দিন। সবকিছু কেমন–কেমন যেন। সুখময়ের কাজে মন লাগে না। রিক্সা জোরে জোরে টেনে চলছে। নাক–ঘাড় বাতাসকে কেটে চলছে। সুখময় আরো জোরে রিক্সা টানে, সুখময়ের দেহ চনমন করে ওঠে, আজ দেহ সুখ চায়। দেহ খুঁজে বেড়ায় কোন মানবীকে।
কোথাও গান বেজে চলছে–
দুষ্ট কোকিল ডাকেরে,
কুক কুক কুক…
গানের তালে সুখময়ের দুষ্ট কোকিল তিরিং বিরিং নড়েচড়ে ওঠে।
রিক্সা আরো জোরে চলে, কিছুদূরে শান্তির ঘর।
সুখময় শান্তিকে দেখতে পায়,
শান্তির পোড়া বাঁশের মত ফিনফিনে দেহ, আগাগোড়া সমান, দেহের কোথাও কোনো ভাঁজ নেই। পরনে হলুদ, নীল, খয়রি রঙের কটকটে ছাপা শাড়ি। লাল রংয়ের কাঁকড়া–ব্যন্ড দিয়ে উঁচু করে চুল বাঁধা। কানে লম্বা ঝুল দেওয়া সোনা কালারের দুল। শান্তি কোমর বেঁকিয়ে দুহাত মাথার উপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
শান্তি: আরে আইজ দেখি আমাগো ডেড়ায় সুইখা রাজায় আইছে,
আহো আহো…
সুখময় হাসে, ঠোঁট দিয়ে অভয় দেয়, হবে আজকে–
শান্তি: আইজ কিন্তু ৪০০ টেকা পুরাই দিবা–
সুখময়: হ অইবো নে–
তুই আমার পেট মন দুইটাই ভরাইয়া দে আগে–
শান্তির ডেরায় পচা ছালার গন্ধ। ঘরের বেড়ায় ভেজা কাপড় গুঁজে রেখেছে শান্তি। চৌকির উপর শীতলপাটি বিছানো। পার্টির উপর আঠা–আঠা বালিশ, বালিশের রং কোনো কালে হয়তো সবুজ বা নীল ছিল। এখন ময়লায় রঙ হারিয়ে গেছে।
শান্তি গাছের লেবুর পাতা ছিঁেড় আনে, মাটির মটকা থেকে নারিকেলের আইচা সরিয়ে ঠান্ডা জল তুলে নেয়। সিলভারের বড় মগে ঠান্ডা জল, লেবু, চিনি, এক চিমটি লবণ দিয়ে নেড়েচেড়ে সুখময়ের হাতে দেয়।
লেবুজল সুখময় এর গলা দিয়ে নেমে বুকে, নাভিতে, পায়ের তলায় বুড়ো আঙ্গুলে, সারা শরীরে সুখ ছড়িয়ে দেয়।
শান্তি চুলায় মোটা চালের ভাত বসিয়েছে। ঘন হয়ে যাওয়া মাড়ের গন্ধে সুখময়ের নেশা–নেশা লাগে।
সুখময়: আইজ কি রানবি?
শান্তি: আইজ কালিজিরে, সরিষা দিয়া ডিমের পাতলা ঝোল করুম বলে শান্তি ঠোঁট চোখা গোল করে হাসে। ঠোঁট চোখা করাতে শান্তিকে কালো হুক্কার মত দেখতে লাগে।
শান্তি কালো জিরে ,সরিষা, কাঁচা মরিচ নোড়া পিসনিতে ঘষছে।
দুলে দুলে শান্তি মসলাগুলো ঘষছে। শান্তির নড়াচড়ার সাথে,শান্তির গায়ের দুর্গন্ধ নড়াচড়া করে।
একসময় সব শান্ত হয়। মাড় ফোটা বন্ধ হয়ে ভাতের সাথে আষ্টেপিষ্টে লেগে থাকে মাড়।
সুখময় ঘাড় কাত করে শান্তির ঘরের বেড়ায় লাগানো কাগজের ছবিতে ভগবানের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, সুখময়ের দু’চোখের কোনায় জল চিকচিক করে ওঠে, মনের ভিতরে আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে, “ভগবান গো আমার অবন্তিরে তুমি বাঁচাও”।
সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে অবন্তির মা–অবন্তি কাউকে দেখতে পায় না সুখময়। ক্ষিতিশের মায়ের কাছে জেনে নেয়, অবন্তিকে নিয়ে তার মা ফণীন্দ্র ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। অন্ধকার ঘরে মশার সাথে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকে সে, এক সময় অপেক্ষা করে করে অপেক্ষার শেষ হয়। ঘুমিয়ে পড়ে সুখময়।
সকালে ঘুম থেকে উঠেও দুজনের কাউকেই দেখতে পায় না সুখময়।
শূন্য ঘরে বসে থাকে সে অনেকক্ষণ,
অবন্তির জন্য বুকের ভিতর হু হু করে কেঁদে ওঠে সুখময়ের হৃদয়,
ঝাপ খুলে কোপ খাওয়া কুকুরকে আদর করে বুকে টেনে নেয় সুখময়, এ যেন সুখময়ের অবন্তিমা,
কুকুরের মুখে মুখ ঘষে,
কুকুর কুঁইকুঁই শব্দে সুখময়ের কাছে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। রাস্তায় অনেক লোকের হট্টগোল শোনা যায়, জনা দশেক শিশু বুড়ো হৈ হৈ করছে,
কেউ ন্যাংটো, কেউ গলায় কড়ির মাদুলি, কেউ ময়লা হয়ে যাওয়া সাদা ধুতি, কারো বা হাতে পলিথিনে পেঁচানো দু’কাপ চা, দ’ুটো পরোটা। সবার ঠোঁটে ফুর্তি,
সুখময়: কি হইছে রে সবুইল্যা,
সুবল: নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে বুঝালো অমলের বাপ আর শিখা একলগে কলপাড়ে ধরা পড়ছে, বাইন্ধা রাখছে দুইটারে। হি হি হি, দূরে কোথাও গান বেজে চলছে…
প্রতিদিন কত খবর আসে যে
কাগজের পাতা ভরে,
জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে।
আজ সুখময় বড় রাস্তায় গাড়ি চালায়।
জোরে জোরে গাড়ি টানে,
রিক্সা চলছে–
রিক্সার সামনে ছোট একটা খুকিকে দেখতে পায়। খুকি রাস্তা পেরোচ্ছে, নীল রঙের স্কুলের ফ্রক গায়, দুই বিনুনি করা।
অবন্তির মতোই বয়স, দেখতেও অবন্তির মতই মিষ্টি।
সুখময় ভাবে এ–যেন আমার অবন্তি–
সুখময় ঘন্টা বাজায়, খুকি সরে না, আবারও রিক্সায় ঘন্টা বাজায়,
সরে না–
না না, খুকিকে বাঁচাতে হবে–এক পাশে সরে যায় সুখময়। খুকি বেঁচে যায়, রিক্সাও বাঁচে, কিন্তু সামনের পিকআপ ভ্যানের চাকায় সুখময় এর মাথা থেঁতলে যায়।
সন্ধ্যায় থানাতে সুখময়ের নিথর দেহ পড়ে থাকে।
চাটাই দিয়ে পেঁচানো দেহটা ভ্যানের উপর পড়ে আছে।
দূরে অবন্তি আর অবন্তির মা চাটায়ের ফাঁকে বের হওয়া ধুলাবালি মাখা সুখময়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেঁদে চলছে…