সংস্কার অবশ্যই টেকসই হতে হবে, নিবর্তনের পুনরাবৃত্তি নয়

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের প্রেস ব্রিফিং যে কোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হওয়া দরকার

| বৃহস্পতিবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক গতকাল বুধবার জোর দিয়ে বলেছেন, গত কয়েক দশকে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের পরিকল্পিত সংস্কার অবশ্যই টেকসই হতে হবে। তিনি বাংলাদেশে তার দুই দিনের সরকারি সফর শেষ করার পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, এবার, অবশ্যই ন্যায়বিচার হতে হবে। এইবার, সংস্কার অবশ্যই টেকসই ও স্থায়ী হতে হবে, যাতে গত কয়েক দশকের নিবর্তনমূলক অনুশীলনের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তুর্ক মৌলিক পরিবর্তনের জন্য দেশের বর্তমান সুযোগের কথা তুলে ধরে বলেন, এ ধরনের পরিবর্তন মানবাধিকারের সমুন্নত রেখে শাসন, উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে একটি নতুন পথ নির্ধারণ করতে পারে। খবর বাসসের।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে কোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হওয়া দরকার। আমরা হত্যাকাণ্ড ঘটতে দিতে পারি না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সদস্য বা সমর্থকদের বিরুদ্ধে কেবল তাদের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা সমীচিন নয়।

তিনি বিভাজন, বৈষম্য ও দায়মুক্তি অবসানের লক্ষ্যে একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের জন্য সাম্প্রতিক সামাজিক আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত উচ্চ প্রত্যাশাগুলোর উল্লেখ করে বলেন, বৈষম্য, প্রতিশোধ ও প্রতিশোধের চক্র, প্রান্তিকতা, দুর্নীতি ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন অবশ্যই অতীতের বিষয় হওয়া উচিত। তিনি এসব নজিরগুলো ভাঙার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। হাইকমিশনার এই লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে তার দপ্তরের প্রতিশ্রুতিও নিশ্চিত করে উল্লেখ করেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সফল করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর সবকিছু করতে প্রস্তুত রয়েছে। তিনি মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া সাম্প্রতিক বিবৃতিকে স্বাগত জানান। তুর্ক প্রধান উপদেষ্টার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সকল প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবেলার গুরুত্ব উল্লেখ করেন।

তিনি বিচার বিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ, সাংবিধানিক বিষয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশ করার লক্ষ্যে দ্রুত বিভিন্ন কমিশন গঠনের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রম অধিকার এবং নারী বিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য অতিরিক্ত কমিশন গঠন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তিনি বলেন, এসব সংস্কার বাংলাদেশে কয়েক দশকের তীব্র রাজনৈতিক বিভাজন কমিয়ে আনার এবং পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতিকে দমন করার জন্য একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হতে পারে যা এর গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, জুলাই ও আগস্টে নিহত ও গুরুতর আহত বিক্ষোভকারী এবং শিশুসহ অন্য জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংস সহিংসতার বিচারের প্রয়াস অগ্রাধিকার পাবে। তুর্ক বাংলাদেশের সকল হত্যাকাণ্ডের তদন্তের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে সমাবেশের ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুরক্ষার আহ্বান জানান।

জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান সতর্ক করে বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক হত্যার অভিযোগসহ কিছু অভিযোগ যথাযথ তদন্তে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে উদ্বেগ রয়েছে। অতীতের দৃষ্ঠান্তের পুনরাবৃত্তি না করা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপক সংখ্যায় মিথ্যা মামলা দায়ের করার বিষয়টি মোকাবেলা করার একটি হাতিয়ার হিসাবে অন্তর্র্বর্তী সরকার কর্তৃক একটি কমিটি গঠনকে তুর্ক স্বাগত জানিয়ে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া অপরিহার্য। তুর্ক বলেন, ফৌজদারি বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে যাতে অভিযোগ আনা না হয় এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)সহ সকল পর্যায়ে যথাযথ প্রক্রিয়া ও ন্যায্য বিচারের মান বজায় রাখা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আমি আশা করি অন্তর্র্বর্তী সরকার অতীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হবে।

ভবিষ্যতে মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োগ নিয়েও জনসমক্ষে আলোচনা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, আইন ও প্রমাণের তথ্যের ভিত্তিতে স্পষ্ট; মৃত্যুদণ্ড অতীতের বিষয় হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ছাত্ররা তাকে জানিেেছন যে তাদের উদ্বেগ শোনার জন্য দেশে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় রাস্তায় নামা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, সামাজিক সংহতি এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা পুনরুদ্ধার করার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অব্যাহতভাাবে কণ্ঠরোধ হয়ে যাওয়া নাগরিক অবস্থানের পুনর্গঠন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। এ জন্য ভিন্নমত রোধ করাসহ দমনমূলক আইনগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার প্রয়োজন হবে।

তিনি বলেন, শুধুমাত্র পদ্ধতিগত পরিবর্তনই নিশ্চিত করবে যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকারকে সম্মান করা হবে। তুর্ক সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মতপ্রকাশের অপরাধের পুরানো মামলা প্রত্যাহারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।

হাইকমিশনার বলেন, যে কোনো দমনপীড়ন, অভ্যুত্থান ও সহিংসতার পর এগিয়ে যাওয়ার জন্য সত্য প্রকাশ ও ক্ষত কাটিয়ে ওঠার একটি জাতীয় প্রক্রিয়া থাকা দরকার। তুর্ক গুম সংক্রান্ত সনদে বাংলাদেশের অনুমোদন এবং একটি তদন্ত কমিশন নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছেন। জাতিসংঘের ফ্যাক্টফাইন্ডিং মিশন গত ৫ থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তদন্ত করছে। তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা বাড়ানোর জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থাসহ এই ধরনের ঘটনার জন্য কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনভেম্বরের শেষে শুরু হচ্ছে বার্ন ইউনিট প্রকল্পের কাজ
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা