দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:৪২ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

শেরাটনের ব্যুফে ব্রেকফাস্টের সম্ভার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। এটা সব ফাইভ স্টার হোটেলই দেয়। তবে এখানে মনে হয় অতি সাধারণ কিছু খাবারকেও অসাধারণভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। লাল আলু সেদ্ধতে আমার চোখ আটকে গেলা। এই ধরনের আরো কিছু আইটেম চোখে পড়লো যা সচরাচর তারকাখচিত রেস্তোরায় পরিবেশন করা হয়না। শতাধিক আইটেমের সব তো আর খাওয়া যায় না। তাই শুরুতে একটু ঘুরেটুরে দেখে নিতে হয়। তারপর শুরু করতে হয় খাওয়া। চীনা রেস্তোরায় আরো একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। যেজন্য ঘুরে ঘুরে আগে সবকিছু দেখে নিচ্ছিলাম। খাবারের উপর সেঁটে দেয়া নামেও চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম।

নদীর পাড়ে অনেকক্ষন হাঁটাহাঁটি করেছি, তাই আমার ক্ষুধাও বেশ চনমন করে জানান দিচ্ছিল। ঘোরাঘুরি শেষ করে আমি প্লেটে খাবার নিতে শুরু করলাম। শুরুতে স্যুপ এবং নুডলস নিলাম। কোন ঝামেলা পাকিয়ে রাখা হয়েছে কিনা তা আগেভাগে খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম। লায়ন ফজলে করিম ভাইও বেশ সতর্কতার সাথে বেছে বেছে খাবার নিচ্ছিলেন। স্বামী যা নিচ্ছিলেন তা থেকে টুক করে অল্পস্বল্প তুলে নিচ্ছিলেন ডালিয়া ভাবী। ধ্রুবকে দেখলাম খুবই সামাণ্য খাবার নিয়ে নিজের মতো করে খাচ্ছে। আসলে ব্যাপারটি হয়েছে কি, ধ্রুব বহুদিন ধরে সাংহাইতে। এখানের নাড়ি নক্ষত্র সবই তার নখদর্পণে। খাবার দাবারের ব্যাপারেও সবই তার চেনা! বড়সড় এই আয়োজনে স্বল্পাহারী ধ্রুবের কোন পরিবর্তন হলো না। সে তার মতো কি একটা নিয়ে খেয়ে নিয়ে মোবাইল টিপতে লাগলো।

সাংহাই শেরাটনের বিশাল রেস্তোরাঁয় শত শত নারী পুরুষ। চ্যাপ্টা নাকের চীন কোরিয়া কিংবা জাপানসহ সন্নিহিত দেশগুলোর পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক পশ্চিমাও নাস্তা খাচ্ছিলেন। আন্তর্জাতিক মানের খাবারদাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যার যেভাবে ইচ্ছে নিয়ে খাচ্ছে। লাল আলু সেদ্ধ থেকে কচু পর্যন্ত এমন কোন আইটেম নেই যা এখানে পরিবেশিত হচ্ছে না। শাক এবং গাছ বাঁশের কী অপূর্ব সমাহার। সবই নাস্তার আইটেম। মাংসের দিকে না গিয়ে আমি সবজির দিকে ঝুঁকলাম। ছোলা মটর থেকে শুরু করে বাদামের হরেক ব্যবহার। এগ স্টেশনে অমলেট মামলেট থেকে পোচ পর্যন্ত নানা আয়োজন। নুডলস এবং স্যুপের পর্ব শেষ করে আমি অন্যান্য খাবারগুলোর দিকে আবারো চক্কর দিতে শুরু করলাম।

চা কফি মিল্কশেক রয়েছে একপাশে। নাস্তাপর্ব সেরে তরুণী ওয়েটারকে এক কাফ গরম কফি এনে দিতে বললাম। সবকিছু ব্যুফে হলেও কফি একটু আয়েশ করে খেতে হয়। মেশিন থেকে নিজে কফি বানিয়ে তা টেবিল পর্যন্ত বয়ে এনে খেতে কোনদিনই আমার ভালো লাগে না। শেরাটনেও করলাম না। মেয়েটিকে অর্ডার করে পাতের শেষ বাদামটিতে কামড় দিলাম। মিষ্টি মেয়েটি বেশ আনন্দচিত্তে আমাদের জন্য সুন্দর করে মগভর্তি কফি নিয়ে আসলো।

লায়ন ফজলে করিম ভাই কফির মগে চুমুক দেয়ার প্রায় সাথে সাথে ফোন বেজে উঠলো। তিনি চীনা ভাষায় কি কি সব আওড়ে গেলেন। ফোন বন্ধ করে আমাকে বললেন, একটু দ্রুত খেতে হবে। গাড়ি কাছাকাছি চলে এসেছে।

আমি কিছুটা নির্ভার ভাবে বললাম, লিডার রাখেন তো। আমরাতো আর প্লেন ধরতে যাচ্ছি না। দু’চার দশ মিনিট দেরি হলে প্রাইভেট গাড়িতে এমন কোন অসুবিধা হবে না। সকালের প্রথম কফিটা একটু আয়েশ করে খেতে দিন। সকালের প্রথম কাপ চা কিংবা কফি আমার কাছে প্রথম প্রেমের মতোই মোহনীয়। করিম ভাই আর কথা বাড়ালেন না, হাসলেন। হাসলেন ডালিয়া ভাবীও। আমাদেরকে এখন জ্যাক কোম্পানির গাড়ি নিতে আসছে। খাওয়ার পর্ব শেষ হলেই গাড়িতে চড়ে বসতে হবে।

আমরা চীন সফর করছি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্টস মেশিনারীজ উৎপাদনকারী চীনা প্রতিষ্ঠান জ্যাক টেকনোলজির অতিথি হিসেবে। লায়ন ফজলে করিম তাদের বাংলাদেশের এজেন্ট। আমাকে আনা হয়েছে বিদেশী সাংবাদিক হিসেবে। রোবটসহ বেশ কিছু ইকুইপমেন্টের কমিশনিং দেখানো হবে আমাদের। বিশ্বের নানা দেশ থেকে হাজার দুয়েক অতিথি এবং বেশ কিছু সাংবাদিককে অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানের আগে আমাদেরকে আরো বিভিন্ন বিষয় সরজমিনে দেখানো হবে। ঘোরানো হবে চীনের নানা অঞ্চল। আমাদের জন্য চমৎকার সব আয়োজন তারা করে রাখে, রেখেছে। গতবারও তাদের অতিথি হিসেবে চীন ঘুরেছিলাম। সেই মুগ্ধতার রেশ আজো যেনো রয়ে গেছে। আমি জানি যে, যতক্ষণ চীনে ঘুরছি তখন দেশটির অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি জ্যাক টেকনোলজির একটি সুনজর আমাদের ঘিরে রয়েছে।

সাংহাইতে আমাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে। নাস্তা শেষে আমরা রুমে ফিরে সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। হোটেল থেকে চেকআউট করে প্রয়োজনীয় ক্লিয়ারেন্স হাতে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বিশাল একটি বাস এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে। বাসটি খুবই সুন্দর। দারুণ ডিজাইন, দোতলা বাসের মতো উঁচু। নিচে লাগেজ স্পেস, সিটগুলো উপরে। বাসটি থামার সাথে সাথে অনেকটা ছটফটিয়ে দ্রুত নেমে এলো ফ্রান্সি এবং শাশা। ফ্রেন্সি এবং শাশার সাথে আমার আগেও দেখা হয়েছে। চট্টগ্রামেও তাদের সাথে ডিনার করেছিলাম। দু’জনই জ্যাক কোম্পানির পদস্থ কর্মকর্তা। তবে বড় ইভেন্টে তারা বিদেশী অতিথিদের প্রটোকলের দায়িত্ব পালন করেন। গতবারও তারা আমাদের সাথে ছিলেন। বেশ বুঝতে পারলাম যে, এবারও দুজন আমাদেরই সাথেই পড়েছেন। নাক খাড়া না হলেও মেয়ে দুইটি দারুণ সুন্দরী, স্মার্ট। শাশা স্পেনিস এবং ইংরেজীতে তুখোড় আর ফ্রান্সি ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজীতে। দুজনই একটু আধটু বাংলা বোঝেন, তবে বলতে পারেন না।

শাশা এবং ফ্রান্সি তাদের চাইনিজ নাম নয়, ইংরেজী নাম। তাদের চাইনিজ নাম আলাদা। ফ্রান্সির চাইনিজ নাম চেন সিয়ুয়ান এবং শাশার চীনা নাম এঙিয়া গোহুয়া।

দু’জনই আমাদের ব্যাগ টেনে নিলেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে, বিশাল বাসটিতে একজন মাত্র চালক রয়েছেন। কোন সহকারী নেই। যাত্রী সেবা থেকে শুরু করে সবই চালকই করেন। বয়স্ক মানুষ, তাই ফ্রান্সি এবং শাশা আমাদের ব্যাগগুলো টেনে লাগেজ স্পেসে তুলে দিলেন। অবশ্য আমরাও হাত লাগাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুই তরুণী আমাদেরকে অনেকটা ঠেলে বাসের ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন।

বাসের ভিতরে শুধুমাত্র দুইজন মানুষকে বসে থাকতে দেখলাম। একজন দারুণ সুন্দরী মহিলা, অপরজন শ্যামলা রঙের সাদামাটা যুবক। তরুণীর শরীরে টপস ও মিনি স্কার্ট, যুবকের পরনে হাফপ্যান্ট, টিশার্ট। হাতের মুঠোয় হাত নিয়ে তারা নিজেদের মতো গল্পে মেতে ছিলেন। আমাদের চোখে চোখ পড়তে হেসে হ্যালো বললেন। পরিচয়পর্বে জানা গেলো যে, যুবকটি জ্যাকের কলম্বিয়ার এজেন্ট, তরুণী তার স্ত্রী। কলম্বিয়ান। আমার শাকিরার কথা মনে পড়ে গেলো।

বাসে আর কোন মানুষজন নেই। সব মিলে চালকসহ আমরা আটজন মানুষ। চল্লিশ সিটের বিশাল বাসটির সবগুলো আসনই ফাঁকা। আমরা দুই সিট নিয়ে যথেষ্ট জায়গা নিয়ে বসে পড়লাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো। আমি পেছনে ফিরে শেরাটনে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে নিলাম। পর্দা সরিয়ে চোখ রাখলাম কাচের বাইরে। সাংহাইতে আর ফিরে আসা হবে না। আদৌ আর কোনদিন সাংহাইতে আসবো কিনা তাও জানি না। শেষবারের মতো মমতা নিয়ে আমি সাংহাইর রাস্তাঘাট, সুউচ্চ ভবন, সবুজ গাছগাছালি, চকচকে রাস্তাসহ সবকিছুতে চোখে বুলাতে লাগলাম।

আমাদের বিমানে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু পথিমধ্যে বেশ কয়েকটি পর্যটন এলাকা দেখার সুযোগ পাবো বিধায় বাসে চড়ে যাচ্ছি। আমরা চারশ’ কিলোমিটারের মতো পথ বাসে যাবো। তবে টানা নয়, একেবারে থেমে থেমে। পথে কয়েকটি শহরে তারকাখচিত হোটেলে আমরা রাত কাটাবো। অন্তত তিনদিন সময়ে আমরা সাংহাই থেকে তাইজু হয়ে পরে বিমানে চড়ে গুয়াংজুতে সামিল হবো।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। বিশাল হাইওয়ে ধরে ছুটছি আমরা। কখনো কখনো আট লেন কখনো দশ লেনের বিশাল সড়ক। চীনের সড়কের বর্র্ণনা দিতে আর ইচ্ছে করছে না। নখের পিঠের মতো রাস্তা কি করে যে বানানো যায় কে জানে! রাস্তার দুইধারে লাখো কোটি গাছ, অযুত নিযুত ফুলের সমারোহ! এতো বর্ণিল ফুল কি করে যে রাস্তার এতো কাছে টিকিয়ে রাখা হয়েছে কে জানে। কোথাও কোথাও গাছের পরিচর্যা হচ্ছে, অত্যাধুনিক মেশিনে কেটে ফেলা হচ্ছে রাস্তার উপর চলে আসা বাড়তি ঢালপালা, ফুলের গাছে পানি দেয়া হচ্ছে মেশিনে, রাস্তায় ঝাড়ু দেয়া হচ্ছে গাড়ির সাহায্যে। সেটিও মেশিন। রাস্তা ধরে গাড়ি এগুচ্ছে, গাছের বাড়তি ডালপালা কেটে নিচে পড়ে যাচ্ছে, সেই পাতাগুলো আবার মেশিনই কুড়িয়ে গাড়িতে ভরে নিচ্ছে। রাস্তার পাশ ধরে গাড়ি চলে যাচ্ছে, অথচ সেই গাড়ি থেকে এমনভাবে ঝর্ণার আদলে পানি ফেলা হচ্ছে যে, তা প্রতিটি গাছের গোড়া ভিজিয়ে দিচ্ছে। রাস্তার পাশের গাছ বা ফুল বাগান কোনটিই লাওয়ারিশ নয়, সবগুলো বেড়ে উঠছে পরম যত্নে, মমতায়! এসব দেখে আমার হিংসে হচ্ছিল, বুকের ভিতরে কেমন কেমন লাগছিল। কী এক আজব দেশরে বাবা! বিশ্বের কারখানাখ্যাত চীনে সবকিছুই কী মেশিনে করে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক ফালি সুখস্মৃতি
পরবর্তী নিবন্ধভাষা বিজ্ঞানী অধ্যাপক মনিরুজ্জামান : কিছু স্মৃতি