সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে খাদ্যশস্য পরিবহন

চট্টগ্রাম থেকে খাদ্য পরিবহন । ১০ বছরে অর্ধশতবার বাড়ানো হয় মেয়াদ । নানা উদ্যোগের পরও নতুন ঠিকাদার নিয়োগ সম্ভব হয়নি

হাসান আকবর | বুধবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম থেকে শত শত কোটি টাকার খাদ্যশস্য পরিবহনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কবল থেকে এ সেক্টরকে মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও নতুন ঠিকাদার নিয়োগ সম্ভব হয়নি। গত ১০ বছরে অন্তত অর্ধশতবার মেয়াদ বাড়িয়ে আগের ঠিকাদারদের হাতেই খাদ্য পরিবহনের ভার তুলে দিতে হচ্ছে।

চট্টগ্রাম থেকে অন্যান্য জেলায় খাদ্যশস্য পরিবহনে ঠিকাদার রয়েছেন ৪৬৮ জন। জেলার অভ্যন্তরে পরিবহন ঠিকাদার রয়েছেন ২৪ জন। চট্টগ্রাম থেকে খাদ্য পরিবহনে দুই ক্যাটাগরিতে কাগজেকলমে ৪৯২ জন ঠিকাদার থাকলেও কার্যত পুরো ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করেন হাতেগোনা কয়েকজন; যারা কোটি কোটি টাকার খাদ্যশস্য চোরাপথে বিক্রি করাসহ নানা অপকর্মে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময় তাদের অপকর্ম ধরা পড়লেও চক্রটি বরাবর রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর এবং সাইলো থেকে আমদানিকৃত খাদ্যশস্য পরিবহন করা হয়। ওখান থেকে হালিশহর ও দেওয়ানহাট সিএসডি ছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় পরিবহন করা হয়। একইসাথে অন্যান্য জেলায়ও পাঠানো হয়। সড়কপথে খাদ্যশস্য পরিবহন করে খাদ্য বিভাগের অনুমোদিত পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম থেকে অন্যান্য জেলায় যারা খাদ্যশস্য নেন তাদেরকে ডিআরটিসি, জেলার অভ্যন্তরে যারা পরিবহন করেন তাদেরকে আইআরটিসি বলা হয়। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে এসব ঠিকাদার কাজ করেন। এর মধ্যে ডিআরটিসি রয়েছে ৪৬৮টি প্রতিষ্ঠান এবং আইআরটিসি রয়েছে ২৪টি প্রতিষ্ঠান।

জানা যায়, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে পরিবহন ঠিকাদার (ডিআরটিসি) নিয়োগ বন্ধ রয়েছে ২০১৯ সাল থেকে। জেলার অভ্যন্তরীণ খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার (আইআরটিসি) নিয়োগ বন্ধ রয়েছে ২০১৫ সাল থেকে। ডিআরটিসি নিয়োগ বন্ধ রয়েছে মামলা সংক্রান্ত জটিলতায়। আইআরটিসি বন্ধ রয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই। নতুন নিয়োগ না হওয়ায় পুরাতন ঠিকাদারদের দিয়ে খাদ্য পরিবহন করা হচ্ছে। ২০১২ সালের টেন্ডারে উল্লেখিত দরেই এসব ঠিকাদার পণ্য পরিবহন করেন।

কম দরে পণ্য পরিবহন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, পণ্য পরিবহনের আড়ালে সংঘবদ্ধ চক্রটি কোটি কোটি টাকার পণ্যের চোরা কারবার করে। তারা কোনো পণ্য পরিবহন না করেই সরকার থেকে কোটি কোটি টাকার ভাড়া হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতি মাইলের ভাড়া হিসেবে বিল আদায় করা হয়। প্রচলিত নিয়মে হালিশহর বা দেওয়ানহাট সিএসডি থেকে মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ কিংবা অন্যান্য উপজেলায় খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়ার পর মাইল হিসেবে বিল আদায় করার কথা। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো অধিকাংশ খাদ্যশস্য নগরীর পাহাড়তলী এবং খাতুনগঞ্জে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্পের সাথে জড়িত লোকজন খাদ্যশস্যের পরিবর্তে নগদ টাকা নিয়ে নেন। উপজেলা পর্যায়ের খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নগদ টাকার লেনদেন হয়, খাদ্যশস্য পরিবাহিত হয় না। এসব খাদ্যশস্য বাজারদরের চেয়ে কম দামে কিনে নেয় পরিবহন ঠিকাদারের সিন্ডিকেট। তারা এগুলো চাক্তাইখাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলীতে বিক্রি করেন। আবার গন্তব্যে গাড়ি না পাঠিয়ে সরকার থেকে ভুয়া বিল আদায় করেন। দুদিকেই লাভের কারণে চক্রটি বছরের পর বছর ধরে পরিবহন ঠিকাদারি ব্যবসা একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।

চট্টগ্রাম থেকে তিন পার্বত্য জেলাসহ জেলা পর্যায়ে পাঠানো খাদ্যশস্যের একটি বড় অংশও একইভাবে কাগজেপত্রে পরিবাহিত হয়, বাস্তবে বিক্রি হয় চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে। বিভিন্ন সময় অন্যান্য জেলার খাদ্যশস্যবাহী ট্রাক চট্টগ্রামে ধরা পড়ার ঘটনা ঘটলেও সংঘবদ্ধ চক্রটি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।

চট্টগ্রাম থেকে খাদ্যশস্য পরিবহনে দুর্নীতির ব্যাপারে বিভিন্ন সময় গোয়েন্দা সংস্থা একাধিক রিপোর্ট দিয়েছে। বিভিন্ন ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালী চক্রটি অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে।

চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের আওতাধীন এলাকায় খাদ্য পরিবহনের জন্য ২০১৩ সালে সর্বশেষ টেন্ডারে ২৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া ওই ২৪টি প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৫ সালের জুনে। এরপর থেকে প্রতি তিন মাস পর পর মেয়াদ বাড়িয়ে ওই ২৪টি প্রতিষ্ঠানকে রাখা হয়েছে। কাগজেপত্রে ২৪টি প্রতিষ্ঠান হলেও মূলত ৪/৫টি প্রতিষ্ঠান পুরো ব্যবসাটি নিয়ন্ত্রণ করে। বিগত সরকারের প্রভাবশালী একজন নেতার দাপটে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের টেন্ডার হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা স্বীকার করেন।

চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন জেলায় খাদ্যশস্য পরিবহনের ৪৬৮টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালের জুনে তাদের মেয়াদ শেষ হয়। অথচ তারাই কাজ করছে। নতুন ঠিকাদার নিয়োগের জন্য কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সংঘবদ্ধ চক্রটির কারসাজিতে তা হয়নি। ২০২২ সালের ৬ জুলাই নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চট্টগ্রাম আরসিফুড। ঠিকাদার নিয়োগের কিছু প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই বছরের ২৬ জুলাই এক ব্যক্তি ‘রক্তপাতের আশঙ্কা’ করে ঢাকার একটি আদালতে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে মামলা করেন। মামলার প্রেক্ষিতে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ কার্যক্রমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। ওই বছর একই ইস্যু তুলে নারায়ণগঞ্জ আদালতেও একটি মামলা করা হয়েছিল। দুই মামলার কারণে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের ব্যাপারটি আর আলোর মুখ দেখেনি।

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, এখানে নতুন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই নানা কৌশলে টেন্ডার ঠেকাতে মরিয়া পুরনো ঠিকাদারদের একটি প্রভাবশালী চক্র। তারা নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে দফায় দফায় টেন্ডার প্রক্রিয়া ভণ্ডুল করে দিচ্ছে।

ঠিকাদার নিয়োগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুমাইয়া নাজনীন আজাদীকে বলেন, জেলায় কতজন পরিবহন ঠিকাদার আছে সেটা এই মুহূর্তে আমার জানা নেই। কেন নতুন পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগ বন্ধ রয়েছে তার খোঁজ নেব। অচিরেই ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করব।

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এস এম কায়ছার আলী আজাদীকে বলেন, মামলা থাকার কারণে খাদ্যশস্য পরিবহনে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। মামলার সুরাহা হওয়ার পর এই ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখাতুনগঞ্জে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম
পরবর্তী নিবন্ধপ্রথম দিনই চালকের আসনে প্রোটিয়ারা