চাকুরির নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টিই পারে বেকারত্ব দূর করতে

রতন কুমার তুরী | সোমবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:৪৮ পূর্বাহ্ণ

দিনদিন বেকারত্ব প্রকট আকার ধারণ করছে। দেশে বর্তমানে ২৪ লাখেরও ওপরে শিক্ষিত বেকার রয়েছে। এর বাইরে অল্প শিক্ষিত এবং অর্ধ শিক্ষিত বেকারও রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক।

একটি দেশের বেকারত্ব বিষয়টি রাষ্ট্র শাসকদের বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। বছরের পর বছর শুধু শিক্ষিত নাগরিক তৈরি করলেই হয় না এদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের একান্ত দায়িত্ব। এর জন্য দেশে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরির দিকে মনোযোগী হওয়া জরুরি। বাংলাদেশে সরকারি চাকরির সুযোগ রয়েছে মাত্র পনের লাখ মানুষের। তাও তা বছরে বছরে খালি হয় না। এর বাইরে বেসরকারি স্কুল কলেজ পর্যায়ে কাজ করছে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ যদিও তাদের বেতন তেমন সন্তোষজনক কিংবা সরকারি চাকরিজীবীদের মতো নয়। এর বাইরে গার্মেন্টস, বিভিন্ন শিল্প কারখানায়ও বেশকিছু মানুষ কাজ করছে। তাও এদেশে বেকারত্ব লেগেই আছে।

এদেশে বেকারত্ব লেগে থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে, চাকুরির ক্ষেত্র কম এবং প্রতিযোগি বেশি। দেশে নতুন নতুন শিল্প কারখানা তেমন একটা গড়ে ওঠছে না বিধায় বছর বছর ধরে বেকারের সংখ্যা শুধু বাড়ছেই। দেশের উল্লেখযোগ্য একটি চাকরির বহুল খাত হচ্ছে পোশাক শিল্প খাত। এ খাতে কাজ করছে দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী শ্রমিক। এ খাতটিও মাঝেমাঝে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শ্রমিক অসন্তোষ জনিত কারণে। এখানে কিছু পোশাক কারখানার মালিক শ্রমিকদের তাদের শ্রমের মূল্য সঠিকভাবে দিতে চায় না। তারা তাদের খাটাতে চান কম পারিশ্রমিক দিয়ে। ফলে এ খাতটিতে অসন্তোষ লেগেই থাকে। যদি একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে এসমস্ত পোষাক কারখানাগুলো চালানো যেতো আর এসব নীতিমালা যদি কারখানা সমূহের মালিকরা মেনে চলতো তাহলে পোশাক কারখানা হতো এদেশের সবচেয়ে বৃহৎ শৃঙ্খলাবদ্ধ শিল্প। আর এ শিল্পে শিক্ষিত বেকারদের পদায়ন করে চাকরি দেয়া কোনো ব্যাপারই ছিলো না। যে কোনো সরকার চাইলে এখাতকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এখানে তাদের অর্থ লগ্নি করে নতুন নতুন পোশাক কারখানা গড়ে তুলে বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। এতে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে এবং পোশাক রপ্তানি করে দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালীও হবে। দেশের আরেকটি অবহেলিত খাত হচ্ছে চা শিল্প। এ শিল্পের প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও এ পর্যন্ত কোনো সরকারই এ শিল্পের প্রতি নজরই দেয়নি। দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় সমূহে চা শিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকলেও নতুন করে কোনো চা বাগান সৃষ্টির জন্য এপর্যন্ত কোনো চা বাগান মালিক এগিয়ে আসেনি। ফলে এ খাতটি অবহেলিত রয়েই গেছে। নতুন নতুন চাকরি চা বাগান সৃষ্টি করে এ শিল্পকে আরো উন্নত করা যেতো এবং এখানে চাকরির নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা যেতো। এখন চা বাগানগুলো চলছে সেই পুরনো ব্রিটিশ আমলের নিয়মে। তাদের এ নিয়মগুলো পরিবর্তন করে চা শ্রমিকদের মুজুরি বাড়ানো উচিত। এ শিল্পে কর্মরতদের মজুরি অত্যন্ত কম হওয়ায় এখানে উচ্চ শিক্ষিতরা সহজে কাজ করতে চায় না। মজুরি বাড়লে এ শিল্পেও বেকারদের কর্মসংস্থান হবে। একসময় এদেশের পাটশিল্প পৃথিবী বিখ্যাত ছিল। এটির প্রতি অবহেলা আর প্লাস্টিকের পলিথিন এবং প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর দেশে অবাধ প্রচলন হওয়ার এখাতটি প্রায় ধ্বংসের পথে। অথচ একসময় এদেশে অনেকগুলো পাট কারখানা ছিল সেখানে লক্ষ লক্ষ লোক কাজ করতো। এখন সময় এসেছে পাটশিল্পকে পুনরুজ্জীবন দেয়ার। পাটশিল্পকে ফিরিয়ে আনা গেলে দেশের অসংখ্য বেকারের কর্মসংস্থান হবে এবং পরিবেশ বান্ধব পাটও আবার ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব। মুলতঃ পলিথিনকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধের আওতায় আনতে পারলে পাটের ব্যাপার সহজেই বৃদ্ধি পাবে। তবে পাটের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করতে পাটজাত পণ্য সমূহের বহুবিদ ব্যবহার সম্পর্কে মানুষকে আগে জানাতে হবে। প্রয়োজনবোধে রাষ্ট্র তা নিজ দায়িত্ব বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার প্রচারনা চালাতে পারে। এ বিষয়ে মানুষকে পরিবেশের বিষয়টিও জানাতে হবে। এবং পাটের তৈরি পণ্যসামগ্রী ব্যবহার করলে যে আমাদের দেশের কর্মসংস্থান হবে, বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করা যাবে এসমস্ত বিষয়গুলো মানুষের মাথায় ঢুকানো গেলে নিশ্চয় মানুষ আবার পাটের প্রতি ধাপিত হবে। এর বাইরে দেশে আরো অনেকগুলো খাত রয়েছে যেমনপর্যটন খাত, কৃষি খাত, আবাসন খাত, কম্পিউটার খাত ইত্যাদি। মূলত এ খাতগুলোতে অর্থ লগ্নি করতে হবে এবং এসব খাতে সরকারি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে পারলেই এসব খাত থেকে লাভবান হওয়া যাবে। এসব খাতগুলো চালাতে যে লোকবল প্রয়োজন তা বেকারদের একটি অংশ দিয়ে চালানো সম্ভব হবে ফলে বেকারত্ব স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আমাদের দেশে বিদেশি দাতারা যেভাবে অবকাঠামোগত কাজে বিদেশি সাহায্য প্রদান করে সে হারে কলকারখানা করার জন্য করে না। বিদেশিদের এদেশে নতুন নতুন কলকারখানা করার জন্য আকৃষ্ট করতে হবে এবং তাদের বোঝাতে হবে যে ব্যবসা করার জন্য আমাদের দেশ খুবই উপযুক্ত এবং এখানে প্রশিক্ষিত শ্রমিকের কোনো অভাব হবে না। এভাবে বুঝিয়ে বিদেশি দ্বারা বেশকিছু কলকারখানা তৈরি করা গেলে উক্ত কলকারখানাগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান করা যাবে এবং আমাদের দেশের বেকারত্বও কিছুটা দূর হবে। প্রকৃতপক্ষে দেশের বেকারত্ব দূর করতে চাকরির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে এবং ক্ষেত্র সমূহে টেকসই বিনিয়োগ করতে হবে তবেই আমাদের দেশ থেকে স্থায়ীভাবে বেকারত্ব দূর হবে। বিষয়টি বেশ কঠিন এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সাপেক্ষ হলেও অসম্ভব কিছু নয়। আমরা বর্তমান সরকারের কাছে চাকরির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরির প্রক্রিয়া শুরু বিষয়ে সদিচ্ছা প্রত্যাশা করছি। এ সরকার যদি একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে তাতে কিছু বেকারকে চাকুরি প্রদানের মাধ্যমে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে তাহলে পরবর্তী সরকারগুলোও তাদের দেখানো পথে হাঁটতে বাধ্য হবে। আশা করছি বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার দেশের ২৪ লক্ষাধিক শিক্ষিত বেকারের কথা চিন্তা করে বিষয়টি আন্তরিকতার সাথে বিবেচনা করবেন।

লেখক : কলেজ শিক্ষক এবং প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের বিয়ের কৃষ্টি কালচার
পরবর্তী নিবন্ধমরমী ও সুফীবাদ : গ্রন্থকারের বয়ানে