অর্থনৈতিক সংস্কারেও মনোযোগ দিতে হবে

| সোমবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:৪২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে শনিবার সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, অর্থনৈতিক সংস্কার টেকসই করার জন্য রাজনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক না হলে কোনো সংস্কারেই কাজে আসবে না। এর আগে সংস্কারের সুযোগ এলেও ফলপ্রসূ কিছু হয়নি। নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক সংস্কারেও মনোযোগ দিতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকার এলে অর্থনীতিসহ অন্যান্য সংকট মোকাবিলা করা সহজ। অনুষ্ঠানে জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘গত ১০১৫ বছরে আমলারা কীভাবে ব্যবসায়ী হয়ে গেল, ব্যবসায়ীরা কীভাবে রাজনীতিবিদ হয়ে গেল, আর রাজনীতিবিদ কীভাবে ব্যবসায়ী হয়ে গেল? এই দুষ্টচক্রটা কীভাবে সৃষ্টি হলো এবং সেটার ভেতরে আমাদের কী অংশগ্রহণ ছিল? এটা জনমানুষের না যতখানি ব্যর্থতা, বাংলাদেশের উচ্চবর্গীয় মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।’ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্র বিকল হয়ে গেছে। খুবলিয়ে খেয়ে রাষ্ট্রকে দেউলিয়া করে দিয়েছে। এ রকম একটি রাষ্ট্রযন্ত্র পেয়ে তিন মাসও হয়নি সরকারের। দাবিদাওয়া শুনলে মনে হয় কোনো জগতে বাস করছি। প্রাতিষ্ঠানিক, নির্বাচনী সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক সংস্কারেও মনোযোগ দিতে হবে। দেশের মধ্যে নিশ্চয়তা ও স্থিতিশীলতা আনতে হবে। আমাদের নিজেদের ব্যর্থতা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে না বইতে হয়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রতিটা মুহূর্তে জবাবদিহি না থাকলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না।’ এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘প্রতিবছর ২৫২৭ লাখ কর্মক্ষম লোক বাজারে আসে। এর মধ্যে সরকারি চাকরি করে মাত্র ৫ শতাংশ। বাকি কর্মক্ষম তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন সামাজিক মূলধন, সঞ্চয়। সব সরকারই নানাভাবে সমাজকে বিভক্ত করেছে। একে অপরের শত্রুতে পরিণত করেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক না হলে কোনো সংস্কারেই কাজ হবে না।’ গণতান্ত্রিক সরকার এলে অর্থনীতিসহ অন্যান্য সংকট মোকাবিলা সহজ হবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন। সিজিএসের চেয়ারম্যান মুনিরা খান বলেন, অর্থ পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মিডিয়া যখন দেশের ব্যাংকগুলোকে দুর্বল বলে তালিকাবদ্ধ করে, তখন সেখান থেকে টাকা সরিয়ে ফেলার প্রবণতা বেড়ে যায়, টাকা পাচারের প্রবণতাও বাড়ে। অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘পূর্বোক্ত সরকারের বাজেট এখনো চলছে কেন? বাজেট কেন নবায়ন করা হলো না? আমরা ঋণ নিচ্ছি, কিন্তু শিল্প তৈরি করছি না। ড. ইউনূসের ইমেজ ব্যবহার করে ঋণ নিতে পারছি, কিন্তু শিল্প নিয়ে আসতে পারছি না। রাজনৈতিক বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে না, যা খুবই দুঃখজনক।’

আজকের সংকটের মূল কারণ ‘নিউ লিবারেল অর্থনীতির’ নামে দুর্নীতিগ্রস্ত, লুটেরা, কালো টাকা সৃষ্টির ও দুর্বৃত্তায়ান বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, অর্থনীতির একজন বিদগ্ধ শিক্ষক হিসাবে প্রধান উপদেষ্টা ‘নিউ লিবারেল অর্থনীতির’ নামে দুর্নীতিগ্রস্ত, লুটেরা, কালো টাকা সৃষ্টির ও দুর্বৃত্তায়নের উৎস সম্পর্কে নিশ্চয়ই সচেতন। এই প্রচলিত ব্যবস্থা বাতিল করার সুস্পষ্ট বক্তব্য না আসলে, কথিত ‘ওয়াশিংটন কনসেনশাস’ এর নামে ‘রেগানথেচারের’ লুটেরা আর্থরাজনৈতিক দর্শন থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি না আসলে, মৌলিক ও ইতিবাচক কোনো সংস্কার সঠিকভাবে কার্যকর ও টেকসই হবে না। ব্যবস্থার বদল ছাড়া ব্যক্তির বদল তো কোনো পরিবর্তন কখনো আনেনি। এজন্যই মুক্তিযুদ্ধ বা ‘ভিশন ৭১’ এর পথেই হাঁটতে হবে। যার রাজনৈতিক অর্থনীতি হল ব্যক্তি পুঁজির অবাধ বিকাশ রোধ, সামপ্রদায়িক রাজনীতি বন্ধ, প্রকৃত গণতন্ত্র, ক্রমে বৈষম্যহীন সমাজ বা সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটা। প্রত্যেকটি শাসকদল গত ৫৩ বছর ধরে এর ঠিক বিপরীতে হেঁটেছে। আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় মেধার সম্মিলনে, মানবিক আন্তরিকতায় আমাদের এগুতেই হবে। দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতির দুঃসহ শাসনের অবসানে, অনিশ্চিত আগামী থেকে মানুষকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এই বিকল্পের কোনো বিকল্প নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ট্রেড লাইসেন্সসহ সহজ নীতিমালা করতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য তথ্যপ্রবাহ বাড়ানো প্রয়োজন। এলাকাভিত্তিক কর্মক্ষেত্র তৈরি করার মাধ্যমে ঢাকামুখিতা কমাতে হবে।’ বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ারউল আলম চৌধুরী বলেন, ‘উন্নয়ন নিয়ে যত কথা হয়, কর্মসংস্থান নিয়ে তা হয় না। শিল্প তৈরি হচ্ছে না বিধায় আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।’ সার্বিকভাবে যে কথাটি উঠে এসেছে, তা হলো অর্থনৈতিক সংস্কার। আর তাকে টেকসই করার জন্য রাজনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে