প্রতিদিনই গুনতে হচ্ছে বড় লোকসান

কর্ণফুলী টানেলের এক বছর

এম নুরুল ইসলাম, আনোয়ারা | সোমবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধনের বর্ষপূর্তি হতে যাচ্ছে আজ সোমবার। গত বছর ২৮ অক্টোবর চালুর পর ১১ হাজার কোটি টাকার এই টানেলে লক্ষ্যমাত্রার ১৮ শতাংশ গাড়িও চলাচল করেনি। ফলে প্রতিদিন গুণতে হচ্ছে বড় লোকসান। টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে বড় কোনো শিল্পায়ন না হওয়া, চায়না ইকোনমিক জোনের ভবিষ্যৎ ঝুলে থাকা, কর্ণফুলী সেতুর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি টোল নির্ধারণ, থ্রি হুইলার চলাচলের অনুমতি না থাকাসহ নানা কারণে টানেলে লোকসান আছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব গত শনিবার চট্টগ্রাম এসে টানেল বিষয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন।

জানা যায়, প্রাথমিক সমীক্ষায় টানেলে দৈনিক ২০ হাজার ৭১৯টি গাড়ি চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলীর তলদেশে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের প্রথম ও একমাত্র টানেল উদ্বোধন করেন। টানেল ঘিরে চট্টগ্রাম ছাড়াও সারা দেশের মানুষের কৌতূহলেরও কমতি ছিল না। টানেল চালুর প্রথম দুই মাস দর্শনার্থীর কারণে গাড়ি চলাচলের চাপ বাড়লেও পরে তা ধীরে ধীরে কমে যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত এক বছরে প্রতিদিন গড়ে লক্ষ্যমাত্রার ১৮ শতাংশ গাড়ি চলেছে। ফলে টানেলের রাজস্ব আয়েও ধস নামে। এ পরিস্থিতিতে টানেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। আশাতীত গাড়ি চলাচল না থাকায় শুধুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতিদিন লোকসান গুণতে হচ্ছে প্রায় ২৬ লাখ টাকা। টানেলের এমন লোকসানের মুখে গত শনিবার যোগাযোগ সচিব সরেজমিনে পরিদর্শনে এসে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেন। রাজস্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে আগামী ছয় মাসের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেন বলে জানা গেছে। বৈঠকে টানেলের রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে আয় বাড়াতে কার, মাইক্রোবাসের টোল কমানো, একই সাথে থ্রি হুইলার চালানো যায় কিনা তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ চিন্তাভাবনা করছে।

জানা যায়, কর্ণফুলী টানেলে আশানুরূপ গাড়ি চলাচল না থাকায় শুধুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতিদিন লোকসান গুণতে হচ্ছে প্রায় ২৬ লাখ টাকা। প্রতিদিন যে পরিমাণ গাড়ি চলাচল করছে তা প্রাথমিক সমীক্ষার মাত্র ১৮ শতাংশ। স্থানীয়রা জানান, টানেলকে কেন্দ্র করে চায়না ইকোনমিক জোন চালু করার লক্ষ্যে গত ৫ বছরে এ শিল্পজোনের নামে ভূমি অধিগ্রহণ করে চারপাশে বেড়া দিয়ে শিল্প জোনের নামে জমি দখল করে রাখা ছাড়া আর কিছু হয়নি। চায়না ইকোনোমিক জোন চালুসহ এ এলাকায় ব্যবসাবাণিজ্যের সম্প্রসারণে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ না নিলে টানেলের আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়াকে গাড়ি কম চলাচলের অন্যতম কারণ হিসাবে দেখছেন তারা।

এছাড়া বর্তমানে টানেল প্রান্তের ব্যবসাবাণিজ্য খারাপ। ৭টি ব্যাংক শাখা হয়েছে। প্রায় সব শাখা লোকসানে। বর্তমানে সবগুলো ব্যাংক মিলিয়ে লেনদেনের সংখ্যা আড়াইশর বেশি নয়। গত এক বছরে ৮০ থেকে ৯০টি দোকান হয়েছে। টানেলকে কেন্দ্র করে ৬/৭ খাবারের দোকান হয়েছে। লোকসানের কারণে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন।

টানেল চালুর আগে প্রথম দিকে হুজুগে বেড়েছে জায়গার দাম। টানেল সংলগ্ন এলাকায় গণ্ডা বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ লাখ পর্যন্ত। সেই জায়গার দাম গণ্ডায় কমেছে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।

এলাকাবাসী টানেলের আয় বাড়াতে পারকি সমুদ্র সৈকতের বাস্তবমুখী উন্নয়নসহ মেরিন ড্রাইভ সড়ক আনোয়ারা পারকি হয়ে কঙবাজারের সাথে সংযুক্ত করার দাবি জানান। তাছাড়া গাড়ি চলাচল বাড়াতে পটিয়া আনোয়ারা বাঁশখালী টইটং সড়ককে ৪ লেনে উন্নীত করাসহ শিল্পকারখানা বাড়ানোর দাবি এলাকাবাসীর।

বর্তমানে আনোয়ারা প্রান্তে কোরিয়ান ইপিজেড ছাড়া নতুন শিল্প কারখানা বা কাঙ্ক্ষিত ব্যবসায়িক সম্ভাবনা তৈরি না হওয়ায় নতুন যাত্রা শুরু করা ব্যাংক শাখা ও হাতেগোনা কয়েকটি দোকানপাট ক্রমাগত লোকসান দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এক বছরের মধ্যে আনুপাতিক হারে টানেলে প্রতি মাসে গড়ে গাড়ি চলাচল কমেছে। টানেলকে কেন্দ্র করে প্রয়োজনীয় শিল্পকারখানা, রিসোর্টসহ বিনোদন কেন্দ্র গড়ে না ওঠার কারণে টানেলের প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন কমছে বলে ধারণা। কেউ কেউ টানেল দেখার জন্য একবার পার হলেও দ্বিতীয়বার ওই মুখী হচ্ছেন না। শুধুমাত্র শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যাত্রীরা টানেল ব্যবহার করছেন।

২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু টানেল নিয়ে যে সম্ভাব্যতা জরিপ হয় তাতে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন পার হবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। কিন্তু গত ১ বছরে মাসে গড়ে গাড়ি চলছে ৩ হাজারের কিছু বেশি। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে যে হারে গাড়ি পার হচ্ছে তা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৮ শতাংশ।

টানেলের টুলের দায়িত্বরত কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন জানান, টানেল ফলপ্রসূ করার বিষয়ে সেতু সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা গত শনিবার টানেল পরিদর্শন করেছেন। টানেলের সার্বিক বিষয়ের সব তথ্য সেতু বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রতিদিন আপলোড হয়, এখানে আমাদের বলার কিছু নেই।

তবে কারো কারো মতে, টানেলের ভবিষ্যৎ এক বছরের আয়ব্যয় দিয়ে নিরূপণ সম্ভব নয়। এটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। সুফল পেতে শিল্পায়নসহ আরো কিছু সময়োপযোগী পরিকল্পনা নিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনৌ ও বিমান বাহিনী মানুষের আস্থার প্রতীক : প্রধান উপদেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধপলিথিনের ব্যবহার বন্ধে উৎপাদনস্থলে অভিযান