পাহাড়খেকোদের শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে

| শুক্রবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

পাহাড়খেকোরা সবসময় বেপরোয়া। চট্টগ্রামে পরিবেশ আইন না মেনে পাহাড় কেটে চলেছে ওরা। বাড়ি নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার এবং ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্যও পাহাড় কাটছে এই চক্র। পাহাড়ের মাটি কেটে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়খেকোরা। দিনের আলোয় পাহাড় কাটা চললেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশকর্মীরা। গত ২৩ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে ‘চট্টগ্রামে পাহাড়খেকো যারা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পাহাড় কাটা বিষয়ক একটি গোপন প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে উক্ত প্রতিবেদনে। ‘স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সহযোগিতায় গড়ে ওঠা কয়েকটি সিন্ডিকেট পাহাড়ে ঘর স্থাপন করে তা ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছে। এসব সিন্ডিকেটের কারণে স্থানীয় প্রশাসনের গৃহীত উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে। প্রভাবশালী সিন্ডিকেটটির সাথে সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়িত থাকায় জনমনে সরকারের প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। স্থানীয় থানার ওসিরা এ কাজে জড়িয়ে পড়ায় প্রশাসনের ওপর জনগণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’ চট্টগ্রামের পাহাড় দখল নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের গোপনীয় প্রতিবেদনের অংশ এটি। যেখানে পাহাড় দখলের সঙ্গে সিন্ডিকেটের তথ্য আছে। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন এবং আজাদীর অনুসন্ধানেও প্রভাবশালী কয়েকটি সিন্ডিকেটের খোঁজ মিলে। এসব সিন্ডিকেট শহরের বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় কেটে প্লট তৈরি করে বিক্রি করে। কয়েক জায়গায় গড়ে তোলে আবাসিক এলাকাও। নির্মাণ করা হয় শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সামপ্রতিক সময়ে আবাসিক এলাকা ও সমবায় সমিতির নামেও পাহাড় কাটা হয়। বিভিন্ন সময়ে পাহাড় কেটেছে চসিক ও সিডিএ। জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাহাড় কাটার ফলে ভূমির ঢাল বৃদ্ধি পায়, গাছপালার আচ্ছাদন বিনষ্ট হয়, মাটির দৃঢ়তা হ্রাস পায় এবং বৃষ্টির পানি মাটির গভীরে প্রবেশ করে। এতে পাহাড় ধস হয়।’ ২০১৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বরাবর পাঠানো প্রতিবেদনে পাহাড় দখলকারী ও পৃষ্ঠপোষকদের নাম উঠে আসে। তবে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন পাওয়ার কথা বললেও কখনো পৃষ্ঠপোষকদের নাম প্রকাশ বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। সমপ্রতি আজাদীর হাতে এসেছে প্রতিবেদনটি।

চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হক একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে ২০১১ সালে ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা করেন। এতে বলা হয়, বেশির ভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝরনা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে। ১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করেন। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময়ে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে। এদিকে ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ন্যাচারাল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘এনভায়রনমেন্টাল ডিগরিডেশান থ্রো হিল কাটিং ইন চিটাগং ডিসট্রিক্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাকর্মটি হয় ২০০৫ সালে। এর নেতৃত্বে ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এম এ সাত্তার। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরের খুলশীতে সর্বোচ্চ ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং শহরতলির চৌধুরীহাট এলাকায় সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ পাহাড় কাটা হয়। ৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এসব পাহাড় কাটা হয়। নগর ও আশপাশের ২০০ পাহাড়ের মধ্যে প্রায় ১০০টি কেটে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে বলে গবেষণায় বলা হয়। এভাবে ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে পাহাড়গুলো। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাহাড়গ্রাসী লোভাতুর দখলদারদের মোকাবেলা করতে হবে শক্ত হাতে। কেননা পাহাড়খেকোদুর্নীতিবাজদের শিকড় গভীর ও শক্তিশালী। এ সমাজে তাঁদের অবস্থান বড় মজবুত। এ জন্য প্রশাসন তথা সরকারকে শক্ত হতে হবে। পাহাড় রক্ষা করা খুবই দরকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে