গত ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়েছে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘ছাত্র জনতার অঙ্গীকার, নিরাপদ সড়ক হোক সবার’। এ উপলক্ষ্যে এক বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, প্রথাগত সড়ক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতাকে চ্যালেঞ্জ করে ২০১৮ সালে সংঘটিত শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে গণআন্দোলনের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ত্রুটিপূর্ণ মোটরযান, ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, অবৈধ যানবাহন সড়ক নিরাপত্তার যে ঝুঁকি তৈরি করে, সড়ক পরিবহন মালিক–শ্রমিক তা উপলব্ধি করে এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে নিরাপদ সড়কের প্রত্যাশা পূরণ অনেকটাই সহজ হবে।
প্রায় তিনদশক আগে এই দিনে বান্দরবানে শুটিংয়ে থাকা স্বামী ইলিয়াস কাঞ্চনের কাছে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের অদূরে চন্দনাইশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন জাহানারা কাঞ্চন। সেই থেকে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করে আসছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। ‘পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়’ এই স্লোগান নিয়ে গড়ে তুলেন সামাজিক সংগঠন–নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। নিসচার পক্ষ থেকে প্রতিবছর ২২ অক্টোবরকে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের দাবি জানানো হয়। ২০১৭ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই থেকে প্রতিবছর দিবসটি উপলক্ষে সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি নিসচাসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৯০২ জন নিহত, ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ঘটে ২০২২ সালে। ওই বছর ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৩৫৬ জন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বেশিরভাগই হলেন শিক্ষার্থী। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জন ছিলেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। ওই বছরের মে মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ৮৪ জন শিক্ষার্থী নিহত হন। ফেব্রুয়ারি মাসে নিহত হন ৮৩ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের বড় অংশ নিহত হয়েছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। কিশোর–যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালনা এবং ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া চালকের দক্ষতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে। মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ করতে হবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বে নানা ধরনের পরামর্শ ও সুপারিশ করা হয়। কিন্তু কেউ তাতে কর্ণপাত করেন বলে মনে হয় না। কর্তৃপক্ষও যেন নির্বিকার। ফলে একের পর এক ঘটে চলেছে দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ২০১৯ সালে একটি আইন কার্যকর করা হলেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন আজও নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন সহজেই। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা উদ্বেগজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দুর্ঘটনা রোধে চালকদের ওভারটেকিং করার মানসিকতাও পরিহার করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশের সড়কব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। শুধু চালকদের দক্ষতা বিচার করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি না ঘটে, সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থেকে নিশ্চিত করা আবশ্যক। সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা না করে কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং নিরপেক্ষভাবে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। সড়কে শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে।