৫ই আগস্ট ২০২৪ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বঞ্চিত ব্যবসায়ী সংগঠনের ব্যানারে চট্টগ্রাম চেম্বার পরিচালকদের পদত্যাগের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে পরিচালকরা পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চেম্বারে প্রশাসক নিয়োগ করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এই আন্দোলন। একটা দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ। যে দেশ ব্যবসা বাণিজ্যে যত বেশি হয়রানি মুক্ত ও বাধাহীন সে দেশ তত দ্রুত উন্নতি লাভ করে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি সহায়তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর জোরালো ও কার্যকর ভূমিকাও অপরিহার্য। সেজন্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে সফল, দেশপ্রেমিক, শিক্ষিত, পরিশ্রমী ও নীতিবান ব্যক্তিত্ব আসা প্রয়োজন। কারণ মাঠ পর্যায়ে যারা ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করেন তাদের স্বার্থ, অধিকার, সুযোগ সুবিধা ও প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরার জন্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করে এবং এর ভিত্তিতে সরকার সঠিক নীতি ও সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। আর সঠিক নেতৃত্ব পাওয়া যায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে এর চরম ব্যত্যয় ঘটে। দেশের সব ব্যবসায়ী সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সঠিক নেতৃত্ব গঠিত হতে পারেনি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে নেতৃত্ব নির্বাচনের পরিবর্তে নেতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি চালু করা হয় ও সরকার ঘনিষ্ঠ লোকজনকে জোর করে অধিষ্ঠিত করা হয়। আবার কোন কোন জায়গায় পরিবারতান্ত্রিকভাবে বংশ পরম্পরার নেতৃত্ব বসানো হয়। ফলে ব্যবসায়ী ও দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে সাধারণ ব্যবসায়ীদের মতামত পরিলক্ষিত হয়নি। ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোও সরকারের বিরাগভাজনের ভয়ে ও নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের তোষামোদ, দালালী ও নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলো। ব্যবসায়ীরা দেখেছে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে কিছু বললে বা করতে গেলে গোয়েন্দা সংস্থা ও ইমকাম ট্যাত্ম কর্তৃক অযথা হয়রানি হওয়ার প্রবণতা। তাই তাদের একমাত্র লক্ষ ছিলো সরকারের পক্ষে কথা বলে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করা ও ব্যাংক বীমা ইন্স্যুরেন্সের লাইসেন্স ও অনৈতিক ব্যবসা বাণিজ্যে সরকার থেকে সুযোগ সুবিধা নিতে লিপ্ত থাকার প্রবণতা। ফলশ্রুতিতে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয় আবার অনেকে গ্রেপ্তারের ভয়ে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়েছে।
১৯০৬ সালে ‘চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি বণিক সমিতি ছিল। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে একটি বাদে বাকি বণিক সমিতিগুলো মিলে ‘চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’ গঠিত হয়। যে চেম্বারটি সে সময় একীভূত হওয়ার বাইরে ছিল, সেটি ছিল আগ্রাবাদ চেম্বার অব কমার্স (বর্তমানে–ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ)।এর প্রথম সভাপতি হন জে আই ব্রাউন। ইংরেজ আমলে ইউরোপীয়ানরা এই চেম্বারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে চেম্বারের নেতৃত্ব দেওয়া আটজন ব্যবসায়ী পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যার মধ্যে পাঁচজন মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। এ কারণে চট্টগ্রাম চেম্বারের নেতৃত্বের প্রতি ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বেশি। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময় বিনা ভোটে চট্টগ্রাম চেম্বার দখলে রেখেছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনেরা। এতে চেম্বারটি ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের বদলে এম এ লতিফের চেম্বার হয়ে ওঠে। টানা ১০ বছর পাঁচবার ভোটের বদলে নিজের পছন্দের লোক দিয়ে চেম্বারের নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ফলে ঐতিহ্যবাহী চেম্বারটির নেতৃত্ব নিয়ে আগ্রহ কমেছে ব্যবসায়ীদের। তবে চেম্বারের ১১৮ বছরের ইতিহাসে পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগের ঘটনা এবারই প্রথম। পদত্যাগের আগে চেম্বারের সভাপতি ছিলেন সাবেক এমপি লতিফের ছেলে ওমর হাজ্জাজ।
চেম্বার নিয়ে ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ দীর্ঘ দিনের। ভোট না হওয়া, ব্যবসায়ীদের বঞ্চিত করা ও চেম্বারে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কারণে সবার মধ্যে রয়েছে চরম অসন্তোষ। জানা যায় ২০০৮–০৯ মেয়াদে চেম্বারের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় পর পুরো চেম্বার নিয়ন্ত্রণে নেন এম এ লতিফ। ২০০৪ সালে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী চেম্বারের সভাপতি থাকাকালীন সহসভাপতি ছিলেন তিনি। এরপর ২০০৪ সাল থেকে চেম্বারে ভুয়া ভোটার তৈরির কাজ শুরু করা হয়। চেম্বারের সাড়ে ছয় হাজার ভোটারের মধ্যে দুই হাজার সরাসরি ব্যবসায়ী নন বলে জানান চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। চেম্বারে সর্বশেষ ভোট হয়েছিল ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ। ওই নির্বাচনে এম এ লতিফ সমর্থিত প্যানেল বিজয়ী হন। প্রথমবারের মতো সভাপতি হন মাহবুবুল আলম। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি হন। চট্টগ্রাম চেম্বারে মাহবুবুল আলম ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭–১৯ মেয়াদে বিনা ভোটে পরিচালক হন এম এ লতিফের ছেলে ওমর হাজ্জাজ। এ ছাড়া সদ্য পদত্যাগ করা কমিটির পরিচালক হিসেবে ছিলেন এম এ লতিফের আরেক সন্তান ওমর মুক্তাদির ও মাহবুবুল আলমের মেয়ে রাইসা মাহবুব। অনেকে অভিযোগ করেন, ঐতিহ্যের ধারক–বাহক শতবর্ষী এ চেম্বারটি এখন অনেকটাই জৌলুশহীন। তাই চট্টগ্রামের পুরোনো ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বিশেষ করে বিএসআরএম গ্রুপ, পিএইচপি গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, কেএসআরএম গ্রুপ, ইস্পাহানি গ্রুপ ও কেডিএস গ্রুপের মত ব্যবসায়ীরা চেম্বার থেকে দূরে সরে গেছেন। এসব ব্যবসায়ীদের মতে, অনেক ঐতিহ্য ও সুনামের এ চেম্বারটি এখন একটি গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে তাঁরা চেম্বারটিকে ব্যবহার করছেন। ফলে চেম্বারের নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেকের অভিমত, চট্টগ্রাম চেম্বারের সঙ্গে দূরত্ব ও নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মতপার্থক্যের জের ধরে ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (সিএমসিসিআই) গঠিত হয়। বর্তমানে এর সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ নানা অনিয়ম ও কারসাজির মাধ্যমে চেম্বারের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার এম এ লতিফের হাতে রয়েছে। নামে–বেনামে লতিফ তাঁর নিকটজনদেরকে চেম্বারের ভোটার বানিয়ে রেখেছেন। এর মাধ্যমে তিনি চেম্বারের নেতৃত্ব নিজের কবজায় রেখেছেন। তাই তাঁর সমর্থনপুষ্ট লোক ছাড়া কারো পক্ষে চেম্বারের নেতৃত্বে আসার সুযোগ নেই বলেও জানান ব্যবসায়ীরা।
তবে ইতিপূর্বে ভোট ও নেতৃত্ব নিয়ে যাই ঘটুক না কেন, ভবিষ্যতে এই চেম্বারে সঠিক নেতৃত্ব আসা খুবই জরুরি। কারণ অন্যান্য চেম্বারের সাথে এই চেম্বারের রয়েছে গুণগত পার্থক্য। দেশের আমদানি রপ্তানির প্রায় ৮০–৮৫% কাজ চট্টগ্রাম দিয়ে সংঘটিত হয় এবং দেশের সিংহভাগ রাজস্বও আহরণ হয় এই চট্টগ্রাম দিয়ে। এই চেম্বারের ভূমিকার উপর নির্ভর করবে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সফলতা।তাই সরকারের উচিত এই চেম্বারে একটিভ আমদানিকারক, ট্রেডিং হাউজ,সিএন্ডএফ এজেন্ট, শিপিং এজেন্ট, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠির প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক চেম্বার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া ও ইতিপূর্বে নিবন্ধিত নামসর্বস্ব ও ভুয়া ভোটারদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। যাতে করে নতুন ও গতিশীল নেতৃত্বে দেশের সমৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে চট্টগ্রাম চেম্বার।
লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক