আইয়ুব বাচ্চু শুধুমাত্র একটি শাব্দিক নাম নয়। এই নাম দেশের সঙ্গীত পিপাসু মানুষের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। সেই নব্বই দশকের শুরু থেকে নামটি শুনলেই তারুণ্যের রক্তে নাচন ধরে যেত অনায়াসেই। এখনো চোখে ভাসে চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে অনুষ্ঠিত ওপেন এয়ার কনসার্টে সেসময় সবেমাত্র রিলিজ হওয়া বাচ্চু ভাইয়ের তুমুল জনপ্রিয় গান ‘সেই তুমি কেন…..’ দর্শকদের অনুরোধে তাকে তিনবার গাইতে হয়েছিল। শুধু তাই নয় মঞ্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দর্শকদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পরও দর্শকরা আবারো বাচ্চু ভাইকে স্টেজে এনে এই গানটি শুনেছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে বাচ্চু ভাই এসেছিলেন। খবর পেয়ে বিন্দুমাত্র দেরি না করে দলবেঁধে সবাই চলে গিয়েছিলাম। গান শুনে তৃপ্ত মনে রাত ১১টায় চট্টগ্রাম শহরের বাসায় ফিরে কপালে জুটেছিল পিতার বেদম বেত্রাঘাত। সেই বেত্রাঘাতে শরীরে আগুনের হল্কা বের হলেও সামনাসামনি বাচ্চু ভাইয়ের গান শোনার আনন্দের কাছে তা যেন ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না।
চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়াম মাঠে বাচ্চু ভাইয়ের আরেক কনসার্টে লালখান বাজারের ছেলেদের সাথে পুলিশের ব্যাপক গণ্ডগোল হয়। পুলিশও ব্যাপক হিমশিম খাচ্ছিল এই গণ্ডগোল থামাতে। যেইমাত্র বাচ্চু ভাই মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন হাতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিলেন ‘মারামারি বন্ধ গরন, বেগ্গুনেরে লই আই আজিয়া নাইচ্চুম’– ভোজবাজির মতো নিমেষেই বন্ধ হয়ে গেল গণ্ডগোল। বাচ্চু ভাইয়ের গানের তালে তালে দর্শকদের নাচে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়ামের মাঠ দুলছিল। নিজ স্কুল সেন্ট প্লাসিডস এর প্রাক্তন ছাত্র সংগঠন ওল্ড প্লাসিডয়ান অ্যাসোসিয়েশনের (ওপিএ) প্রোগ্রামে এসেছিলেন বাচ্চু ভাই। গানের তালে তালে সেদিন স্টেজে উঠে উনার সাথে গলা মিলিয়েছিলাম। এ রকম অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে কিংবদন্তি শিল্পী মরহুম আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের সাথে।
চট্টগ্রামের প্রত্যেকটি কনসার্টে তিনি গর্বের সাথে বলতেন, ‘আরা চিটাইংগা পোয়া, মেডিত ফইরলে লুয়া।’ চট্টগ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশকে তিনি বিদেশেও উপস্থাপন করেছেন তার গান ও গিটারের সুরের মূর্ছনায়। অনেক প্রখ্যাত শিল্পী তাকে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ গিটারিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করতেন।
ক্ষণজন্মা এই শিল্পী বড় অসময়ে সকলকে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছিলেন চোখের পলকে। আজ ১৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম তথা সমগ্র বাংলাদেশের গর্ব কিংবদন্তী শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। বাচ্চু ভাই খুবই ভালোবাসতেন বাংলাদেশকে, ভালোবাসতেন নিজ জন্মস্থান চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামবাসীকে। বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামবাসীও বাচ্চু ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছিলেন দুই হাত উজাড় করে। জানাজায় লাখো চট্টগ্রামবাসীর অশ্রুসিক্ত উপস্থিতি তারই প্রমাণ দেয়। আজও বাচ্চু ভাইয়ের কথা উঠলে চট্টগ্রামবাসী নীরবে অশ্রু বিসর্জন করে।
বাচ্চু ভাইয়ের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে শুধু এটুকুই বলবো…. ‘যতদিন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে পানি প্রবহমান থাকবে, ততদিন চট্টগ্রামবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে তাদের প্রিয় আইয়ুব বাচ্চুকে।’
লেখক :
গণমাধ্যম কর্মী