চট্টগ্রামসহ সারাদেশে জেলায় জেলায় ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেছেন পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। গতকাল বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রেখে এ কর্মসূচি পালন করেন সারাদেশের মত উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায় কর্মরত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ৩ ঘণ্টার ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে ১৪ উপজেলার ১৩ লাখ ৭০ হাজার পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহক চরম ভোগান্তিতে পড়েন। দক্ষিণ চট্টগ্রামে আনোয়ারা, কর্ণফুলী, বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া– লোহাগাড়া ও বাঁশখালী উপজেলা এবং উত্তর চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা এই ভোগান্তিতে পড়েন।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে একীভূত করার দাবি এবং ঊর্ধ্বতন ২০ জন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি ও মামলায় আসামি করার প্রতিবাদসহ বিভিন্ন দাবিতে সারাদেশের মত চট্টগ্রামেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখে শাটডাউন কর্মসূচি পালন করেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা–কর্মচারীরা।
দেশব্যাপী ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি পালনকালে ‘পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন’ এর ব্যানারে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসারণ, সমিতির কর্মকর্তাদের চাকরি থেকে অবসানের আদেশ ও ‘মিথ্যা’ মামলা প্রত্যাহার করার দাবিতে–প্রধান উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেন।
শাটডাউন কর্মসূচির খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার, ডিজিএমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করার পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে থাকে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের আট উপজেলার একাধিক পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় তিন ঘণ্টা ‘শাটডাউন’ করে রাখার পর সন্ধ্যা ৬টা থেকে সাড়ে ৬টার পর স্বাভাবিক হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আজাদীকে বলেন, বিকেল ৩টার দিকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি–১ এর ২৭টি সাবস্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যার পর অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে এবং সমিতির ২ দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগামী ২০ অক্টোবর আলোচনায় বসার ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্বঘোষিত ‘কমপ্লিট শার্টডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে বলে জানান পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির–১ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী দীলিপ চন্দ্র চৌধুরী জানান, বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে পল্লী বিদ্যুৎ কর্মকর্তা কর্মচারীরা বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৮ উপজেলায় বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে টোটাল শাটডাউন করে বিক্ষোভ করেন। সকাল ১০টা থেকে ধারাবাহিকভাবে ২০জন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ায় মূলত এ আন্দোলন ও বিক্ষোভ দেখা দেয়।
পরে আন্দোলনকারীদের সাথে প্রশাসনসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কথা হলে বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে ধাপে ধাপে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করা হয়। তিনি আরো জানান, আমাদের ৮ উপজেলায় ২৭টি সাবস্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে ১৯ টি পিবিএস এর অর্থায়নে এবং বাকি ৮টি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হয়।
চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি–৩ এর জিএম মৃদুল কান্তি চাকমা আজাদীকে বলেন, আমাদের চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি–৩ এর অধীনে মীরসরাই, সীতাকুণ্ড (পৌরসভা ছাড়া) এবং হাটহাজারী উপজেলায় ২ লাখ ৫০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। সারাদেশের মত আমার এলাকায়ও (পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি–৩) বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের পর প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আমাদের সাথে বসেছেন। আমাদের যে দাবি–দাওয়া ছিল সেগুলো নিয়ে আমাদের কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছেন। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সাথে আমাদের বৈঠকের পর সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে।
চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি–১ এর চন্দনাইশ জোনাল অফিসের ডিজিএম মো. আবু সুফিয়ান আজাদীকে বলেন, আমাদের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি–১ এর অধীনে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আট উপজেলায় বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ২০ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার প্রতিবাদে সারাদেশের ৯০ শতাংশ উপজেলায় বিদ্যুৎ শাটডাউন ছিল। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৮ উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের ৬ লাখ ৭০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে ধাপে ধাপে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবগুলো উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে থাকে।
এদিকে চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি–২ এর ডিজিএম (কারিগরী) জুয়েল দাশ আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা, রাঙ্গুনিয়া উপজেলা এবং রাউজান উপজেলা চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি–২–এর অধীনে। এই তিন উপজেলায় গ্রাহকের সংখ্যা সাড়ে ৪ লাখ। সারাদেশের মতো বৃহস্পতিবার (গতকাল) ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া এবং রাউজান উপজেলায় বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। সাড়ে ৬ টার পর ধাপে ধাপে সব উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড চট্টগ্রামের (উত্তর) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নারিফুর রহমান আজাদীকে বলেন, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ২০ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার প্রতিবাদে সারাদেশে বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ শাটডাউন ছিল। সোয়া ৬টা থেকে ধাপে ধাপে চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি–২ এর অধীনস্থ উপজেলা গুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ স্বাভাবিক হতে থাকে।
আমাদের পটিয়া প্রতিনিধি জানান, দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৮ উপজেলায় বিদ্যুৎতের টোটাল শাটডাউন করে বিক্ষোভ করেছেন পল্লী বিদুৎ কর্মকর্তা– কর্মচারীরা। বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম পল্লী বিদুৎ সমিতি–১ পটিয়া ও তাদের অধীনে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৮টি উপজেলার সাবস্টেশনের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা এ আন্দোলন ও বিক্ষোভ করেন। এতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৮ উপজেলার প্রায় ৭ লাখ পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহক দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিহীন ছিলেন। পল্লী বিদুৎ সমিতি পিবিএস’র ৫ জন সিনিয়র জিএম, ডিজিএম, এজিএম, ওয়্যারিং পরিদর্শকসহ ২০ জন কর্মকর্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদানের প্রতিবাদে ও তাদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে পল্লী বিদ্যুৎতের কর্মকর্তা কর্মচারীরা এ আন্দোলন ও বিক্ষোভ করেন।
বিক্ষোভকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশ পল্লী বিদুৎতায়ন বোর্ড আরইবি ও পল্লী বিদুৎ সমিতি পিবিএস একই সার্ভিস কোটে পরিচালনা করা এবং সকল চুক্তিভিত্তিক চাকরি নিয়মিতকরণসহ বিভিন্ন দাবিতে গত জানুয়ারি থেকে অদ্যবদি বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা। এ আন্দোলনে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তাদের সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় কর্তৃপক্ষ।
আন্দোলন চলাকালে পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। তারা বলেন, আমাদের প্রতি বৈষম্য করে, নানা অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে তারা নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। পক্ষান্তরে আরইবি ও পিবিএস কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি করে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে চাকরি নীতিমালা করা হয়েছে।
আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে পটিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আলাউদ্দীন ভুঞা জনী, পটিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুল ইসলাম, ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নুর, সেনাবাহিনীর একটি টিম, পুলিশ, ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।